গুমোট অবস্থা টবে। কী হবে, কী হচ্ছে নানা প্রশ্ন চারদিকে। চলতি জুলাই মাস থেকে এক দফার আন্দোলন শুরু করতে চায় বিরোধী দলগুলো। আর এ আন্দোলন মোকাবিলায় প্রস্তুত সরকারি দল। আন্দোলন-পাল্টা শোডাউনে রাজপথ উত্তপ্ত হচ্ছে জুলাইয়ে। রাজনীতির এই উত্তপ্ত বার্তার মধ্যে এ মাসেই ঢাকা আসছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। অনেক উচ্চ রাজনৈতিক এ প্রতিনিধিদলের সফর দেশের রাজনীতির জন্য বয়ে আনতে পারে নতুন কোনো বার্তা। এ মাসেই ঢাকা সফরে আসতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল। যে দলটি নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মতামত দেবে। তাদের মতামতের ওপর নির্ভর করবে ইইউ’র নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি।
সব মিলিয়ে রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্ট হতে যাচ্ছে জুলাই। হিসাব কষলে জুলাই শেষে হাতে আর সময় বেশি নেই। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। নির্বাচনের প্রস্তুতি সবই শুরু হয়ে যাবে এই সময়ে। তার আগে বিরোধী দলগুলো চাইছে তাদের দাবি আদায় করে নিতে।
সরকার চাইছে নিজস্ব ছকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের মাঠে নামাতে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে ঘোর অনিশ্চয়তা রাজনীতির মাঠে। সংঘাত না সমঝোতা এই প্রশ্ন সামনে আসছে বার বার। নানা শঙ্কা মানুষের মাঝে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও চলছে নানা সমীকরণ। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি সমমনা দলগুলোকে নিয়ে এক দফার আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন নেতারা। আন্দোলন করে সফল হলে সরকার পরিচালনায় ৩১ দফার একটি রূপরেখাও প্রায় চূড়ান্ত। এক দফা আন্দোলনে নামার পাশাপাশি দলগুলোর পক্ষ থেকে যৌথ এই রূপরেখাও ঘোষণা করা হতে পারে এ মাসে। এ ছাড়া পুরো মাসজুড়ে বিএনপি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। মূল দল, অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চও নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে। সূত্রের দাবি বিএনপি, গণতন্ত্রমঞ্চ সহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো চলতি মাসেই এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দিতে পারে। এটি একক মঞ্চ থেকে হবে- না আলাদা মঞ্চ থেকে হবে- তা নিয়ে ভাবছেন নীতিনির্ধারকরা। সূত্রের দাবি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
ওদিকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টির অবস্থান এখনো দোটানায়। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের এখন সরকারবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানাচ্ছেন। তবে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে। জিএম কাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদকে ঘিরে বেশ কিছু নেতা সরকারের সঙ্গে থাকার পক্ষে সক্রিয়। তারা জিএম কাদেরকে বেকায়দায় ফেলতে সময়ে সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তাদের এসব তৎপরতা অবশ্য হালে পানি পায়নি। দলটির নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের এখন ব্যাপক কৌতূহল দলটিকে নিয়ে। জাতীয় নির্বাচনে কেমন অবস্থান হয় দলটির এ প্রশ্ন সবার। দলীয় সূত্রের দাবি পরিস্থিতি বুঝে জাতীয় পার্টি কৌশল ঠিক করতে চায়। এজন্য এখন আপাতত ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। প্রয়োজন হলে বিরোধী আন্দোলনেও শরিক হতে পারে দলটি। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা হলে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
এতদিন বিএনপি’র জোটে থাকলেও রাজনীতির মাঠে এখন এক রহস্যের নাম জামায়াত। তারা কী করবে, কী করছে তার কিছুই পরিষ্কার না। এ কারণে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের। যদিও দলটির নেতারা পরিষ্কার করেছেন এমন কোনো কিছু হয়নি। জামায়াত তার নিজস্ব অবস্থান থেকে কর্মসূচি পালন করে যাবে। অনেকে বলছেন, দৃশ্যপটে মনে হচ্ছে জামায়াতে এখন দুটি ধারা সক্রিয় রয়েছে। তরুণনির্ভর একটি ধারা যে করেই হোক নির্বাচনে যেতে চাইছে। এই ধারাটির কারও কারও সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ রয়েছে বলেও বলা হচ্ছে।
দলটির একটি সূত্রের দাবি- অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই দলটি আর সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতিতে যেতে চায় না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচনসহ আন্দোলন কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। সর্বশেষ গত ১০ই জুন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সমাবেশ রাজনীতিতে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। সরকারি অনুমতি নিয়ে করা এ সমাবেশে নেতাদের অনেকের বক্তব্যও কিছু রহস্যের জন্ম দেয়। ওই সমাবেশের পর অনেকে বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ভিসা নীতির কারণে জামায়াত সহজে এই সমাবেশে করতে পেরেছে। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই ওই সমাবেশ করার সুযোগ পায় দলটি। সমাবেশের পর এমন আলোচনা সমালোচনার মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য সমঝোতার গুঞ্জনের ডালপালা মেলতে সাহায্য করে। যদিও ওই সমাবেশের পর জামায়াতের পক্ষ থেকে আর বড় কোনো কর্মসূচি পালন করা হয়নি। যদিও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আগে থেকেই নিজেদের অবস্থান জানিয়ে আসছে জামায়াত। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, কোনো জোটে না গেলেও জুলাই থেকেই তারা নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করবেন।
জামায়াতের মতো ধোঁয়াশার মধ্যে আছে আরেক ইসলামী দল- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম হামলার শিকার হওয়ার পর বেশ সক্রিয় দলটির নেতাকর্মীরা। বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন দলের আমীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। নির্বাচনকালিন একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। এজন্য একটি রূপরেখাও উপস্থাপন করেছে দলটি। কিন্তু রাজনৈতিক কোনো জোটে যাবে কিনা বা নিজেরা কোনো জোট গঠন করবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট করেনি দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতার কারণে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থান কী হবে তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলগুলোর অবস্থান ও কর্মসূচি সতর্ক নজরে রেখেছে আওয়ামী লীগ। দলের নেতারা বলছেন, জুলাই থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মাঠের কর্মসূচি বাড়ানো হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-কর্মসূচির বিপরীতে নিয়মিত সভা-সমাবেশ করা হবে। শান্তি সমাবেশের বাইরে জনসভা ও নির্বাচনী প্রচার সভাও হবে বিভিন্ন স্থানে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় সভানেত্রীও বিভিন্ন জেলা সফর করবেন। এসব সভা ঘিরে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করা হবে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল আসছে ঢাকায়। ওই প্রতিনিধিদলে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু’র নামও রয়েছে। বাংলাদেশ সফরকালে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এসব বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সুরাহার পথ খোঁজা হতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তার কোনো সুরাহার সূত্রও আসতে পারে ওই সফর থেকে। সূত্রের দাবি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, মানবাধিকার এবং দ্বিপক্ষীয় বিষয় প্রতিনিধিদলের সফরে গুরুত্ব পাবে। সফরের সুনির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশ না করা হলেও মধ্য জুলাইয়ে এটি অনুষ্ঠিত হবে এমনটা ধরে নিয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা কাজ করছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এর আগে গত জানুয়ারিতে ঢাকা সফর করে গেছেন মার্কিন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। দুইদিনের ওই সফরে তিনি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সরকারের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন।
ধারণা করা হচ্ছে, ডনাল্ড লু’র সফরের ফলোআপ হিসেবেই উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরটি হচ্ছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সমঝোতার পরামর্শ দেয়া হতে পারে মার্কিন প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে। এছাড়া চলতি মাসেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলও ঢাকা আসতে পারে। এই দলটির প্রতিনিধিরাও আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ অন্যান্য দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হবেন। এই প্রতিনিধি দলের রিপোর্টের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।