মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে আমি হারাতে চাইনা। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হলে লাভ কী হবে ? মুত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হলে আমার জন্য কী বেহেস্তের দরজা খোলা থাকবে ?’
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকে : ‘মুত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হলে আমার জন্য কী বেহেস্তের দরজা খোলা থাকবে ? বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া সম্মানী ভাতার টাকাও আমি নেই না, আমার সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা চাকুরির ক্ষেত্রেও আমি মুক্তিযোদ্ধার কোঠা নেইনি। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও আমার লজ্জা লাগে। আমি কোথাও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ও দেইনা। দিয়ে লাভ কী ? আমার কাছে এখন মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা দু’টোই পণ্য মনে হয়। এখন তা বেচা-কেনার পণ্য হয়ে গেছে। আমাদেরতো (মুক্তিযোদ্ধাদের) বয়স হচ্ছে, আমাদের তালিকাতো ছোট হওয়ার কথা। দিনে দিনে তালিকা বড় হতেই আছে। কেনো ? এ সুযোগ কেনো পাবে অমুক্তিযোদ্ধারা ? এটা আমার ক্ষোভ নয়, এটা আমার প্রতিবাদ।’
তীব্র ক্ষোভের সাথে এমনি ভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রতিবাদের ভাষা ব্যক্ত করলেন দিনাজপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মেয়র সফিকুল হক ওরফে ছুটু। বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ওরফে ছুটু’র বাড়ি দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ী এলাকায়। তিনি ভাষা সৈনিক মো. আমিনের ছেলে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ডাটা বেইজ নং ৭১, গেজেট লাল মুক্তিবার্তা নম্বর- ৮৪। মুক্তিযুদ্ধের সময় দিনাজপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। দু’বার দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র ছিলেন। বর্তমানে দিনাজপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, এম আবদুর রহিম সমাজকল্যাণ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্র, আমার চ্যানেল আই দর্শক ফোরাম সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর ভাষা সৈনিক পিতা ও ছোট ভাইকে হত্যা এবং বড় ভাইকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে পাক সেনারা। সেইসব স্মৃতি এখনো বিদ্রোহ করে তোলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মেয়র সফিকুল হক ছুটু’কে।
দিনাজপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালে প্রতিবেদক শাহ্ আলম শাহী’র সাখে কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মেয়র সফিকুল হক ছুটুর সাথে। তিনি কেনো রাষ্ট্রীয়ভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া সম্মানী ভাতার টাকা নেন না এবং কেনো মুত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন চান না তা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে এ বিষয়ে জানাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। পরে ক্ষিপ্ততার সূরে এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন এই প্রতিবেদনের সাথে।
তিনি বলেন,‘আমি ভাতা নেই না, আমি মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ সুবিধা কোন দিন নেইনি। আমার সন্তানরা লেখা-পড়া করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় নয়। আমি কোন অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেইনা। নিজেকে লজ্জা লাগে। আমি অমুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে হারাতে চাইনা। এখন অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হয়েছে। অধমি পরিচয় দিলে সাধারণ মানুষ ভাববেন, আমিও হয়তো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। একারণেই আমি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন চাইনা। অসংখ্য অমুক্তিযোদ্ধার এখন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে আমি হারাতে চাইনা। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হলে লাভ কী হবে ? মুত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হলে আমার জন্য কী বেহেস্তের দরজা খোলা থাকবে ?’ এমনি ভাবে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে মারেন জাতির বিবেকের কাছে।
মৃত্যুর পরও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা নিতে চান না বলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে রেখেছেন তিনি। বলেছেন, যেনো তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। কারণ হিসেবে জানালেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ধারে কাছে আসেননি, এমন অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন, রাষ্ট্রীয় সম্মান পাচ্ছেন। অথচ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি, যুদ্ধে বাবাকে হারিয়েছি, ভাইকে হারিয়েছি। অ–মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে নিজেকে হারাতে চাই না। ভাতা কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্মান গ্রহণ করতে না চাওয়াটাই আমার প্রতিবাদ।’
তিনি বলেন,‘মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে স্বাধীন করতে আমরা জীবন বাজি রেখেছিলাম। দেশ স্বাধীনের পর আমাদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান দেওয়া হচ্ছে এবং মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হচ্ছে। এটা আমাদের প্রাপ্য ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ না করেও অথচ গত কয়েক বছরে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। সম্মানের সাথে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন এবং মুত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হচ্ছে। আমাদের বয়স বাড়ছে, দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাটা ছোট হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা বড় হচ্ছে। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ নেই। সামগ্রিক উন্নয়ন অব্যাহত হচ্ছে। দুর্নীতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আগামী প্রজন্মই এখন ভরসা। ৫২ বছরেও যা আমরা পারিনি, আগামী প্রজন্মকে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সঠিক ইতিহাস জানাতে পারলে আমাদের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করা সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটুর ঘনিষ্টজন দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক নেতা চিত্ত ঘোষ বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার বিধান করে। ছুটু ভাইয়ের আক্ষেপ, ভুয়া মুক্তিযেদ্ধারাও এই ‘গার্ড অব অনার’ পান। আর বিবেকের তাড়নায় এটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না বলেই এই সম্মান বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মানি ভাতাও গ্রহণ করেন না। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ও দেন না কোথাও। আমরা তাঁকে কাছ থেকে দেখছি, তিনি একজন সৎ-আদর্শবান পরিচ্ছন্ন মানুষ।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মেয়র সফিকুল হক ছুটুর পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন যাতে না করা হয়, এজন্য পরিবারের সকল সদস্যকে জানিয়ে রেখেছেন তিনি। কারণ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে’ দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সয়লাব হয়েছে। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদের আত্মার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। তাই তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন থেকে বিরত রাখতে বলেছেন।
শাহ্ আলম শাহী
দিনাজপুর।
আরো পড়ুন : জেনে নিন জুমার দিন কোন পাঁচ ভুল করা যাবে না