আওয়ামী লীগ সরকারের চার মেয়াদের তিনবারের মন্ত্রী ও একবার সংসদ-সদস্য ডা. দীপু মনি গ্রেফতারের পর ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুস-দুর্নীতির নানা তথ্য বের হতে শুরু করেছে।
বিগত সরকারের প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তৃতীয় মেয়াদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং চতুর্থ মেয়াদে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। এসব পদ-পদবি পেয়ে গত প্রায় ১৬ বছর তিনি বেশ বেপরোয়া ছিলেন। তার হাত থেকে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও রেহাই পাননি।
তারা ছিলেন অনেকটা সংখ্যালঘুর মতো। দীপু মনির দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল সহযোগী ছিলেন তার ভাই জেআর ওয়াদুদ টিপু। এ টিপুর নেতৃত্বে প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়। চক্রে চাঁদপুর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারও ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে তিনি এখন রিমান্ডে আছেন। তবে তার ভাই টিপু ও রতন কুমার এখন পলাতক। দীপু মনির টাকার মেশিন ছিলেন চাঁদপুর সদরের লক্ষীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম খান ওরফে চোরা সেলিম। তার মাধ্যমে চাঁদপুরে বালুমহাল থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন দীপু মনি ও তার ভাই। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে চোরা সেলিম ও তার ছেলে শান্ত খান এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার গণপিটুনিতে মারা যান। চোরা সেলিমের মৃত্যু নিয়েও চাঁদপুরে নানা আলোচনা আছে। অনেকেই ইঙ্গিত করেছেন দুর্নীতির পার্টনার চোরা সেলিমকে কৌশলে উত্তেজিত লোকজনকে উসকে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যাতে দীপু মনি বা তার ভাইয়ের অবৈধ টাকার সাক্ষী না থাকে। এদিকে দীপু মনির অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীপু মনি পাঁচটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কুক্ষিগত করেন। ওই সময় তদবিরের জন্য চাঁদপুরেও চলে আসতে দেখা গেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের। শিক্ষা খাতে ঘুস-দুর্নীতির বিষয় টিপু ছাড়াও স্থানীয়ভাবে দেখতেন চাঁদপুর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করে রতন কুমার মজুমদারকে পুনঃপুনঃ পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ চলমান রাখতেন। যদিও সর্বশেষ মহিবুল হাসান নওফেল শিক্ষামন্ত্রী হয়েই ওই পরিপত্রটি বাতিল করে দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু না হয়েও অঘোষিতভাবে দীপু মনির ভাই জেআর ওয়াদুদ টিপু ও রতন কুমার মজুমদার মিলে সব বদলি, নিয়োগসহ মন্ত্রণালয়ের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনেও বিশাল ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন এ দুজন। এদের ভয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা তটস্থ থাকতেন বলে জানান একজন কলেজশিক্ষক।
মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ পর্যন্ত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হওয়ার সুযোগ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের জন্য দুই কোটি এবং কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য তিনি ৫০ লাখ টাকা ঘুস নিতেন¬এমন অভিযোগ এখন সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে। এছাড়া, শিক্ষা প্রশাসনে প্রতিটি বদলিতে তার ভাইয়ের হাতে ছিল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। সর্বনিæ দুই লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকায় বেচাবিক্রি হতো শিক্ষা প্রশাসনের নানা পদ। তার সময়ে শিক্ষা খাতে ঘুস-দুর্নীতি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। মন্ত্রীর বিভিন্ন কাজে বিতর্কের শুরুর একপর্যায়ে তার দপ্তর থেকে অন্যত্র চলে যান তার তৎকালীন একজন সচিব। এছাড়া নিজ থেকে চলে যান তার একান্ত সচিবও (পিএস)।
রাজধানী কলাবাগান ও বনানীতে ছায়া অফিসের মাধ্যমে দীপু মনির মন্ত্রণালয়ের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করত তার ভাই টিপুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের নাম ছিল ‘রাজনৈতিক স্বজন’। দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তার ভাই টিপুর মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্যের এক বিশাল রাজত্ব কায়েম করেন।
১৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা ও রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত একটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাকে এই কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসতে ৫৫ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে পদায়ন করতে এক শিক্ষকের কাছ থেকে দুই কোটি টাকা নেন তার ভাই টিপু।
নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সুপারিশ আসার পর টিপু অন্য একজনের মাধ্যমে জানান, উপাচার্য হওয়ার জন্য ২ কোটি টাকা দিতে রাজি আছেন কয়েকজন। তদবির করে লাভ নেই। আপনার অধীনে একটি নিয়োগ দিয়েই তো এই টাকা উঠানো সম্ভবÑএমন পরামর্শ দিলে শেষ পর্যন্ত ওই শিক্ষক টাকা দিতে রাজি হন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে কমবেশি আর্থিক লেনদেন হয়েছে।
দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে ২০২২ সালে বেসরকারি নর্থ-সাউথ ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তনের নামে আসলে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় একটি চক্র। এর নেপথ্যে ছিলেন দীপু মনি। আওয়ামী লীগের মেয়র, ব্যবসায়ী, আমলা, শিক্ষাবিদদের দিয়ে নতুন করে গঠন করা হয় নর্থ-সাউথ ও মানারাতের ট্রাস্টি বোর্ড।
এরপর বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও এভাবে বেদখল হয়। বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি বেদখলের উদ্যোগ নিয়েও শেষ করতে পারেননি দীপু মনি। ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর তাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর এ দুই বিশ্ববিদ্যালয় বেদখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। যদিও তা শেষ করতে পারেননি তিনি।
একইভাবে রাজধানী ঢাকার গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ দখল করতে চান সমালোচিত এ শিক্ষামন্ত্রী। তিনি অযাচিত হস্তক্ষেপ করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে কয়েকবার উদ্যোগ নেন। এরপর প্রতিষ্ঠানটির সামনে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। শেষে উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হয়ে রক্ষা পায় প্রতিষ্ঠানটি।
স্কুল-কলেজ ভবন নির্মাণে ৫ শতাংশ কমিশন : শিক্ষার উন্নয়ন বাজেটের বেশিরভাগ বরাদ্দ পায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)। এ খাতে সব ঠিকাদারকে ৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে কাজ নিতে হতো। ইইডির পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল দীপু মনির ভাই টিপুর হাতে। দীপু মনি ও তার ভাই টিপুর হাত থেকে রক্ষা পায়নি চাঁদপুরে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত আল-আমিন একাডেমি নামক প্রতিষ্ঠানটিও। তার ভাই নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু তছনছ করে নিজের লোক বসান।
নিজ জেলায় চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শুধু জমি অধিগ্রহণে ৩৫৯ কোটি টাকা দুর্নীতির পাঁয়তারা করেন দীপু মনি। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভ‚মি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেন তার নিকটাÍীয়রা। তারা ভ‚মি অধিগ্রহণে প্রশাসনিক অনুমোদনের আগেই চাঁদপুর সদর উপজেলার ল²ীপুর ইউনিয়নে জায়গা ঠিক করে নিজেদের নামে দলিল করিয়ে নেন। পরবর্তী সময়ে সেসব জমিই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন করে এবং জেলা প্রশাসনকে অধিগ্রহণের জন্য বলে। সেখান থেকে ৩৫৯ কোটি অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস। তিনি চাঁদপুরে দীপু মনির ভাইসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর জমি দখলের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য আলোচিত ছিলেন। টিপুসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ৪৮ একরের বেশি জমির দখল নেওয়ার প্রতিবাদ জানানোর ৪৮ ঘণ্টা পর তাকে নেত্রকোনায় বদলি করা হয়। পরে সরকার ল²ীপুর ইউনিয়নের সেই জায়গায় ওই বিশ্ববিদ্যালয় করার বিষয়টি বাতিল করে।
চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে ফ্রি-স্টাইলে বালু উত্তোলনেও চোখ ছিল দীপু মনির। তার ঘনিষ্ঠ লোক হিসাবে পরিচিত ল²ীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সেলিম খানকে সেই বালু তুলতে উৎসাহী করেন তিনি। তার ভাই টিপুু সেলিম খান থেকে মোটা অঙ্কের সুবিধা নিতেন। চাঁদপুরে মেঘনা নদী থেকে সেলিম খানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বালু তোলার প্রতিবাদ যারাই করেছেন তারাই দীপু মনির রোষানলে পড়েছেন। চাঁদপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দীপু মনির বিরোধ ও দূরত্ব শুধু বালু উত্তোলন নিয়ে প্রতিবাদ করা নিয়ে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দীন আহমেদকে কোণঠাসা করতে তার বিরুদ্ধে বালুখেকো সেলিম খানের লোকজন দিয়ে শহরে মিছিল করানো হয়। এছাড়াও দীপু মনির কাছের লোকদের দাপটে দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীরাও ছিলেন অবহেলিত।
নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বালু তোলার সমালোচনা করে পদ হারান। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসের আলোচনায় তিনি বলেন, মেঘনায় অবৈধভাবে যারা বালু উত্তোলন করছেন, তাদের সঙ্গে চাঁদপুরের একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে। এর দুদিন পরই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, দীপু মনির নির্বাচনি এলাকা হাইমচর-নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরে বিপুল পরিমাণ খাসজমি নিজের কবজায় নিয়ে দীপু মনির ভাই টিপু তৈরি করেন মাছের ঘের, গবাদি পশুর খামার ও সবজি বাগান। শুধু সরকারি জমির ওপরই নিয়ন্ত্রণ নেননি, ওই এলাকার নাম বদল করে নিজের নামে রেখেছেন ‘টিপু নগর’। যে জমি সরকারি খাস তা প্রভাব খাটিয়ে নামজারি করে নেন দীপু মনির ভাই টিপু।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, নোট-গাইড বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও সারা দেশে দেদার বিক্রি হচ্ছে এসব বই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী নোট বা গাইডের ওপর নির্ভরশীল। মুখে নোট-গাইডের বিরোধিতা করলেও দীপু মনি নোট-গাইড বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে তাকে সহায়তা করতেন এক প্রকাশনীর মালিক। সেই প্রকাশনীর মালিকের বাড়িও চাঁদপুরে। ঢাকার এক নোট-গাইড প্রকাশক জানান, ৩ মাস পরপর অন্তত ২৫ কোটি টাকা কমিশন নিতেন দীপু মনি।
দীপু মনির নির্বাচনি এলাকা চাঁদপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম নাজিম দেওয়ান বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সময় থেকেই তার সঙ্গে আমার দূরত্ব। মন্ত্রীর কাছে কোনো বিষয়ে একটি তদবিরও করেননি বলে তিনি জানান।
আরো পড়ুন : পলকের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন খারিজ করল আদালত