র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে যুগ্মসচিব এনামুল হকের সম্পৃক্ততা খুঁজতে নতুন তদন্ত ছক

অনুসন্ধানী ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ তথ্য-প্রযুক্তি নারী নারী নির্যাতন পুরুষ প্রচ্ছদ মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

নওগাঁ ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিন র‌্যাব হেফাজতে নিহত হওয়ার ঘটনায় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হকের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করতে অধিকতর তদন্তে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এজন্য রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মো. ইমতিয়াজ হোসেনকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে তাকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আরো পড়ুন : সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে তথ্য গোপন করল যুগ্ম সচিব

ঘটনার পরপর রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, এর ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে তদন্তের ব্যাপারে বেশ কিছু গাইডলাইন ও তদন্ত ছক দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। সাধারণ চোখে যা দেখা যায়, তা অনেক সময় সত্য হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। সুতরাং বিষয়টি অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।

আরো পড়ুন : সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে র‌্যাবের তদন্ত কমিটি

মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ঘটনার সঙ্গে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), যুগ্মসচিব এনামুল হক, নিহত ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, মামলার সময় ও তারিখ, সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর সময়, সুরতহাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, ফরেনসিক রিপোর্ট, ভিকটিমের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইস, এনামুল হকের ব্যবহৃত ডিভাইস, ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতি, সুলতানা জেসমিনকে তুলে নেওয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, তাকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আনার সময়ের ভিডিও ফুটেজ, সিটি স্ক্যান রিপোর্টসহ যাবতীয় বিষয়াদি এক্সপার্টদের দিয়ে বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। এরপর বোঝা যাবে কে কতটা দায়ী। সেভাবেই নতুন তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদন দেবেন।

আরো পড়ুন : সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় র‌্যাব সদর দপ্তরের তদন্ত শুরু, ১১ সদস্যকে তলব

এদিকে র‌্যাব হেফাজতে আটক ও সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর একদিন পর (২৩ মার্চ) তার বিরুদ্ধে যুগ্মসচিব মো. এনামুল হক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলা করেছিলেন, সেই মামলার প্রধান আসামি আল আমিনকে নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। চাঁদপুরের হাইমচরের আল আমিনের বিষয়ে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ‘সে একজন পেশাদার হ্যাকার’। কিন্তু র‌্যাবের হাতে ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া আল আমিনের নতুন পরিচয় জানিয়েছে রাজধানীর শাজাহানপুর থানা পুলিশ। পুলিশ বলছে, ‘আল আমিন মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের একজন এজেন্ট। থানা পুলিশের কাছে সর্বশেষ এমন তথ্যই রয়েছে। শাজাহানপুর থানায় আল আমিনের নামে আগে কোনো মামলা ছিল না।’

আরো পড়ুন : বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন জেসমিনের পরিবার

যদিও যুগ্মসচিব তার মামলায় বলেছেন, তার ফেসবুক আইডি হ্যাকড করে প্রতারণার মাধ্যমে আল আমিন ও জেসমিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। র‌্যাব-৩-এর একটি টিম ২৯ মার্চ সকালে ঢাকার মালিবাগে বিকাশের দোকান থেকে আল আমিনকে গ্রেফতার করে। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে নিকটতম শাজাহানপুর থানায় সোপর্দ করা হয়। সোপর্দের সময় র‌্যাবের পক্ষ থেকে থানা পুলিশকে বলা হয়, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক যুগ্মসচিব এনামুল হকের করা মামলার প্রধান আসামি এই আল আমিন। শাজাহানপুর থানা পুলিশ আরও জানায়, আল আমিনকে থানায় হস্তান্তরের পর রাজশাহী মহানগরের রাজপাড়া থানা পুলিশকে জানানো হয় বিষয়টি। কিন্তু রাজপাড়া থানা পুলিশের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে আল আমিনের বিষয়ে কোনো ফেরত বার্তা না পাওয়ায় ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর রাজপাড়া থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ও আলোচিত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুবাস চন্দ্র বর্মণ কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মামলার তদন্তের অগ্রগতি ও প্রধান আসামি আল আমিনকে হেফাজতে নেওয়ার বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র যা বলার বলবেন। আরএমপির মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রফিকুল আলম রোববার বিকালে  বলেন, ‘যুগ্মসচিব এনামুল হকের করা মামলার প্রধান আসামি আল আমিনকে হেফাজেত নেওয়ার কোনো প্রক্রিয়া চলমান আছে কি না, তা আমার জানা নেই। ডিএমপির শাজাহানপুর থানা থেকে আরএমপিকে আল আমিনের বিষয়ে কোনো বার্তা পাঠানো হয়েছে কি না, সেটাও তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে তিনি বলছেন, আলোচিত মামলাটির তদন্তে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে কী অগ্রগতি হয়েছে, তা তিনি বলেননি।

আরো পড়ুন : যুগ্মসচিব এনামুল হক নিজেই প্রতারণা মামলার আসামি

এদিকে প্রশাসনিক তদন্ত কর্মকর্তা হাসপাতালে ভর্তির সময় জেসমিন সুলতানার শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল, সিটি স্ক্যান রিপোর্টে কী ধরনের ইনজুরি উল্লেখ রয়েছে, এ সংক্রান্ত তথ্যও সংগ্রহ করবেন বলে জানা গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মো. ইমতিয়াজ হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, আমি চলতি সপ্তাহেই আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তকাজ শুরু করব। আমাকে তদন্তের জন্য কিছু বিষয় স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে। আশা করি, সেগুলো নিয়ে কাজ করে বেঁধে দেওয়া কর্মদিবসের মধ্যেই প্রতিবেদন দিতে পারব।

জেসমিন সুলতানার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমার তারিখ ৫ এপ্রিল : র‌্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের (৩৮) ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ৫ এপ্রিলের মধ্যে জমা দিতে হবে হাইকোর্টে। এ প্রতিবেদন পাওয়ার পর হাইকোর্ট কী নির্দেশ দিচ্ছেন, সেই অপেক্ষায় আছেন জেসমিনের স্বজনরা। জেসমিনের মামা নাজমুল হক মন্টু বলেন, রোববার জেসমিনের কুলখানি হয়েছে। আমরা শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। ৫ এপ্রিল জেসমিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর হাইকোর্ট কী নির্দেশনা দিচ্ছেন তার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। হাইকোর্টের মতামত জানার পর আমরা মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।

আরো পড়ুন : কোন ক্ষমতাবলে র‍্যাব সুলতানা জেসমিনকে তুলে নিয়েছিল জানতে চায় আদালত

জেসমিনের মৃত্যুর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) মর্গে মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন, প্রভাষক ডা. জামান নিশাত রায়হান ও মেডিকেল অফিসার ডা. তাজনীন জাহান। তারা মরদেহ থেকে বিভিন্ন নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করেন।

এদিকে জেসমিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেয়েছে পুলিশ। রোববার বিকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ফরেনসিক বিভাগ থেকে প্রতিবেদন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে জেসমিনের মৃত্যুর কারণ হিসাবে কী উঠে এসেছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। আদালতে প্রতিবেদন পৌঁছানোর আগে ‘স্পর্শকাতর’ এই বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলবেন না বলে জানিয়েছেন।

জেসমিনের মৃত্যুর পর ২৫ মার্চ রামেকের মর্গে তিন সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড মরদেহের ময়নাতদন্ত করে। এই বোর্ডের প্রধান ছিলেন রামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন। রোববার রাতে তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আজ অফিস সময়ের মধ্যেই পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর কারণ কী এসেছে, সেটা আমি গণমাধ্যমকে বলতে পারব না।’

আরো পড়ুন : সুলতানা জেসমিনকে আটকের নেপথ্যে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা

নগরীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে থাকা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে শুনেছি রিপোর্ট এসেছে। কী রিপোর্ট এসেছে, সেটা আমি জিজ্ঞাসা করিনি। রিপোর্ট কোর্টে গেলে সবাই জানতে পারবে।’

র‌্যাবের তদন্ত এখনো চলছে : ২২ মার্চ র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় র‌্যাব-৫-এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের ১১ জন সদস্যকে রাজশাহীতে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। র‌্যাবের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা রোববারও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। র‌্যাব-৫-এর রাজশাহীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার রোববার দুপুরে জানান, তদন্ত কমিটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। রোববারও তারা কাজ করেছেন। তদন্ত শেষে কমিটি ঢাকায় ফিরে র‌্যাব সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেবেন।

আরো পড়ুন : বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর একসঙ্গে আন্দোলন ও কর্মসূচি ঘোষণার চিন্তা

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *