ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কমেই চলেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রেমিট্যান্স আয় কমেছে। এতে চরমে পৌঁছেছে ডলার সংকট। বেড়ে গেছে আন্তর্জাতিক এই মুদ্রাটির দামও। ফলে বাধ্য হয়ে আমদানিতে লাগাম টেনেছে সরকার। ডলার সংকটে বন্ধ হয়েছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সহ অনেকগুলো প্রকল্প। ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের শিল্প ও উৎপাদন খাত। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণেরও সহজ কোনো পথ নেই বলেও মনে করছেন তারা।
তারা বলছেন, বিগত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমেছে ১২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে কমতে থাকলে সামনে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও ঝুঁকিপূর্ণ হবে। যদিও সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলার সংকট সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। যা অর্থনীতির জন্য আরেকটি ভুল পদ্ধতি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৮ হাজার ১৪৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি। আর জুলাই থেকে জুন মাসে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার এবং প্রবাসী আয় হয়েছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রবাসী আয় কমেছে ১৫ শতাংশ। ফলে যে পরিমাণ আয় হচ্ছে তা দিয়ে ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এরসঙ্গে রয়েছে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ। সবমিলিয়ে সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে গত তিন মাসে ডলারের দাম আনুষ্ঠানিকভাবে ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী আয় আনছে ১০১-১০২ টাকায়। আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে বেশি দামে। ফলে চাপে পড়েছেন আমদানিকারকরা, বেড়ে গেছে সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম। ওদিকে ডলার সংকট মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে টান পড়েছে রিজার্ভে।
প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান বলেন, ডলার সংকটের কারণে দেশে বড় একটি আর্থিক সংকট চলছে। এটি স্থানীয় টাকার সংকট নয়। কারণ ব্যাংকিং সেক্টরে কেউ যদি লোন চায় লোন কিন্তু দিতে পারছে। ব্যাংকের হাতে টাকা আছে এবং সরকার চাইলে বিভিন্নভাবে টাকার অঙ্ক বাড়াতে পারে। টাকা ছাপাতে পারে। কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলার সংকট সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। এটা অর্থনীতিবিদরা মনে করেন অত্যন্ত ভুল পদ্ধতি। তখন আমদানি কম হবে এবং রিজার্ভও কমে আসবে। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তখন অর্থনীতি আরও ঝুঁকিতে পড়বে। মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে। এই সংকটটা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গভীর একটা সংকট। এ থেকে মুক্তির সহজ কোনো উপায় নেই।
জিয়া হাসান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। এক বছরে কমেছে ১২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে মাসিক হারে কমতে থাকলে আগামী বছর এই রিজার্ভ নেমে আসবে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারে। যা এক মাসের আমদানির অর্থও না। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক ও লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ডলার সংকট কতোটা গভীর সেটা আমরা বুঝতে পারি যখন দেশের বড় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ডলারের অভাবে বন্ধ করে দিতে হয়। সংকটা আসলে অনেক গভীর। যেকোনো পেমেন্ট সরকার বিলম্বে পরিশোধ করলে টার্মস এবং কন্ডিশনের ভেতরের শর্তের কারণে সুদ বাড়ে। সুতরাং আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে, গভীরতম ডলার সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দিয়ে দেশে একটি পরিকল্পিত লোডশেডিং বা অন্ধকার ডেকে এনেছে।
তিনি বলেন, যে বিদ্যুৎকেন্দ্র অদক্ষ, যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি বেশি পুড়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অডিট করে বন্ধ করার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক। কারণ যেহেতু এগুলোতে জ্বালানি অপচয় হচ্ছে। এতে ডলারের ক্রাইসিস সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুতের দায়মুক্তি আইনটা তুলে দেয়া যাতে করে ধীরে ধীরে বিদ্যুতের ক্রয় ব্যবস্থাপনায় যে মানহীন যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে, প্রায় ২১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রি-ইউনিট হার্ডওয়্যার সমস্যার কারণে বন্ধ। এগুলো আসলে সরকারের উপরে ডলারের দেনার দায় তৈরি করছে। এসব সমস্যা সমাধানের আশু কোনো সমাধান নেই বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, আশু সমাধান হতে পারে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান হলে। একেবারে বিচ্ছিন্নভাবে আলাদা করে সমাধানের পথ কঠিন।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সংকটটা আসলে গভীর। আমাদের রেমিট্যান্সে হুন্ডি ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ডলারগুলো বিদেশে থেকে যাচ্ছে। সেগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ, আমলা, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস মালিক- তারাই কিনে এই ডলারগুলো বিদেশে পাচার করে নিয়ে রাখছে। যার ফলে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স তেমন বাড়ছে না। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে প্রচুর ডলার রয়ে যাচ্ছে। এই অর্থ পাচার যদি সরকার দমন করতে না পারে এই সংকট সহজে কাটবে না। এটা সরকারকে কঠোর হাতে দমন করতেই হবে। রেমিট্যান্স ফরমাল চ্যানেলে বাড়ানো না গেলে আমাদের আমদানি বিল, রপ্তানি ব্যয় মেটাতে পারবো না। একইসঙ্গে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ দিন দিন কমে যাবে। তিনি বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করা সরকার এখনো কঠোর হাতে দমন করেনি। এটা দমন করা না গেলে ডলার সংকট, রিজার্ভ সংকট এগুলো কোনোটিই কাটবে না। এটিই হলো সংকটের গভীরতা যে, সরকারের ভূমিকা এখানে মোটেও গ্রহণযোগ্য না।
আরো পড়ুন : একেই বলে শাকিব খান