নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁ শহরে আটকের পর র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। সুলতানাকে আটকের নেপথ্যে রাজশাহী বিভাগীয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হকের অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। তার মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই র্যাব ২২ মার্চ সকালে জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায়।
পরে ২৩ মার্চ এনামুল হক রাজশাহী রাজপাড়া থানায় সুলতানার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন; যার নাম্বার ১৬/২৩। র্যাব হেফাজতে গত শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু হয়।
জানা গেছে, সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করতেন।
র্যাবের দাবি, প্রতারণার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। আটকের পর অসুস্থ হয়ে তিনি মারা গেছেন। তবে স্বজনদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
নিহত সুলতানার মামা নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক বলেন, তার ভাগনি বুধবার সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তির মোড় থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে র্যাবের লোকজন তাকে ধরে নিয়ে যায়। তবে তাকে র্যাবের কোনো ক্যাম্প নেওয়া হয়, সে ব্যাপারে তারা কিছুই জানতেন না। দুপুর ১২টার পর জানতে পারেন সুলতানা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেখানে গিয়ে তিনি র্যাবের লোকজন দেখেন; কিন্তু ভাগনি কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ পর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তার মৃত্যু হয়। যদিও লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে শনিবার দুপুরের পর।
তিনি আরও বলেন, ১৭ বছর আগে সুলতানার সঙ্গে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর এক সন্তানকে নিয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে বড় করছিলেন তিনি। শহরের জনকল্যাণ এলাকায় একটা ভাড়া বাড়িতে থেকে ছেলেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন। তিনি ভূমি কার্যালয়ের একজন সামান্য কর্মচারী। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ নেই।
এ বিষয়ে র্যাব-৫-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর নাজমুস সাকিব বলেন, সুলতানার বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার একটি অভিযোগ পায় র্যাব। তার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ ছিল। ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখে র্যাব অভিযোগের সত্যতা পায়। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুক্তির মোড় এলাকা থেকে র্যাবের হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু আটকের পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা তাকে রাজশাহীতে নেওয়ার পরামর্শ দেন; কিন্তু রাজশাহীতে নেওয়ার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হয়। শুক্রবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্টোক করে তিনি মারা যান। আইনি প্রক্রিয়া শেষে শনিবার দুপুরে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মৌমিতা জলিল বলেন, বুধবার দুপুরে র্যাবের লোকজন অসুস্থ অবস্থায় এক নারীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। জরুরি বিভাগে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ওই রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাজশাহীতে পাঠানো হয়। ওই সময় তার শরীরে কোনো চিহ্ন ছিল না।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এফ এম শামীম আহাম্মদ বলেন, তারা যতটুকু জানতে পেরেছেন, র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওই নারী পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। তারপর তাকে নওগাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সিটি স্ক্যান করে তারা জানতে পেরেছেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ওই রোগীর মৃত্যু হয়। তার মাথায় ছোট্ট একটি লাল দাগ ছিল। শরীরে অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
নিহত সুলতানার ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত বলেন, ‘আমার মা চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। যার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।’
নিহত সুলতানা জেসমিনের সহকর্মী কাজী রাফিউল জানান, জেসমিন আমাদের অফিস সহায়ক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি সময়মতো অফিস করতেন। কখনো তার কোনো অনিয়ম আমার চোখে পড়েনি। সে সৎভাবে জীবনযাপন করতেন। অফিসে আসার পথে একজন সরকারি চাকরিজীবীকে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। এভাবে একজন সরকারি চাকরিজীবীর মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।
এ বিষয়ে নওগাঁ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, সুলাতানা জেসমিনকে র্যাব হেফাজতে নেওয়ার আগে আমাদের অবগত করা হয়নি। কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে নওগাঁ সদর থানার ওসি ফয়সাল বিন আহসান জানান, এ বিষয়ে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ অভিযোগ বা মামলা করতে আসেনি। তবে অভিযোগ করলে বিষয়টি আমলে নেওয়া হবে।
অভিযোগের বিষয়ে র্যাবের কর্মকর্তা মেজর নাজমুস সাকিব বলেন, আটকের পর ওই নারীকে র্যাবের কোনো ক্যাম্পে নেওয়া হয়নি। আটকের পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকেই তার পরিবারের লোকজন মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার সঙ্গেই ছিলেন। নির্যাতনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়।
এ বিষয়ে রাজশাহী রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) রহুল আমিন জানান, রাজশাহী বিভাগীয় স্থানীয় সরকার পরিচালক মো. এনামুলক হক সুলতানা জেসমিনের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন। গত ২৩ মার্চ তিনি এ মামলা করেন। এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
আরো পড়ুন : বিআরটির র্যাম্প চালুর সিদ্ধান্ত ঈদের আগেই; বাস্তবায়নে সংশয়