গুরুতর ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজন হচ্ছে প্লাটিলেট। রক্ত জোগাড়ে রাত-দিন হন্যে হয়ে ছুটছেন স্বজনরা। এতে চাপ বাড়ছে ব্লাড ব্যাংকগুলোতে। গত ৩ মাস ধরে ব্লাড ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকের চাপ বেড়েছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। চাহিদা অনুযায়ী রক্তদাতা পাচ্ছে না ব্লাড ব্যাংকগুলো। অনেক গ্রহীতারা রক্ত না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এদিকে ব্লাড ব্যাংকের কর্মীদের চোখে নেই ঘুম। কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে রাত-দিন পরিশ্রম করছেন রক্ত সংগ্রহে। রাজধানীর কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রক্তের জন্য ব্লাড ব্যাংকে গ্রাহকদের ভিড়। প্রতিদিন অনেকে ফোন করছেন আবার কেউ সরাসরি ব্লাড ব্যাংকগুলোতে ছুটে আসছেন।
রক্তের চাহিদা অনুযায়ী সবাইকে তারা রক্ত সংগ্রহ করে দিতে পারছেন না। হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এদিকে রক্ত না পেয়ে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ছুটছেন স্বজনরা। রক্ত গ্রহীতাদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। একজন রোগীর জন্য ষোলো ব্যাগ পর্যন্ত রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে। এক একটি ব্লাড ব্যাংকে প্রতিদিন পঞ্চাশ থেকে সত্তরজন রোগীর জন্য রক্ত চাওয়া হচ্ছে। অন্য সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ চাহিদা বেড়েছে রক্তের।
সূত্রমতে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে যাদের শরীরে প্লাটিলেট কমে যায়, তাদের যত দ্রুত সম্ভব প্লাটিলেট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অ্যাফেরেসিস মেশিন নামের একটি ডিভাইস ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর্মীরা রক্তদাতার রক্ত থেকে প্লাটিলেট সংগ্রহ করেন- যা শিরার মাধ্যমে আক্রান্তদের শরীরে দেয়া হয়।
কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংক ল্যাবের অর্গানাইজার শামীমা নাসরিন মুন্নি বলেন, আমাদের ব্লাড ব্যাংকেও অনেক ভিড়। প্রচুর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টাই ডেঙ্গু রোগীর স্বজনরা ছুটে আসছেন। নরমাল সময়ে সারা বছর ৫০-৬০ ব্যাগের মতো রক্তের চাহিদা থাকে কিন্তু এখন সেটি বেড়ে ১৬০-১৭০ থেকে ২০০ পর্যন্ত ছাড়িয়েছে। এমনকি ৩০০ ব্যাগেরও ডিমান্ড পেয়েছি।
এটি শুধু জুলাই এবং আগস্ট মাসে। রক্তের প্লাজমাটা এত বেশি না লাগলেও প্লাটিলেটের চাহিদা অনেক বেশি। তবে প্লাজমাটা প্রতিদিন প্রায় ২০-২৫ ব্যাগের মতো লাগছে। যেটা আগে বার্নের বা অন্য রোগীদের দেয়া হতো। এটি আগে ৮০-৯০ ব্যাগের একটা চাহিদা থাকতো সেটি এখন ১১০-১২০ ছাড়িয়ে গেছে। আমরা এই মুহূর্তে ৮০ শতাংশ দিতে পারছি বাকি ২০ শতাংশ মানুষকে ফিরে যেতে হচ্ছে। অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাহিদা মতো ডোনার আমরা পাচ্ছি না। একদম মধ্যরাতে যখন এর চাহিদাগুলো আসছে তখন কোনো ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না। ডোনারের কাছ থেকে রক্তটা নিয়ে প্লাটিলেট তৈরি করা হয়। ফ্রিজে রাখা কোনো ব্লাড দিয়ে এটি তৈরি করা যায় না। জুলাই এবং আগস্টে যে পরিমাণ ডোনার পেয়েছি দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বর-আগস্টে এসে অনেকে রক্ত দেয়ার কথা জানাচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীকে। এখন নতুন করে ডোনার খুঁজতে হচ্ছে। বর্তমান ডেঙ্গু জ্বরের কথা মাথায় রেখে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, নতুন ডোনার তৈরি করতে হবে। এই পরিস্থিতিটা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে। আগস্ট মাসে শুধু ৩ হাজার ডেঙ্গু রোগীর জন্য প্লাটিলেট সংগ্রহ করেছি। স্বাভাবিক সময়ে হয়তো এটা ১০০০-১২০০ হতো। আমাদের ব্লাড ব্যাংকে র্যানডম প্লাটিলেটটা সংগ্রহ করা হয়। এই প্লাটিলেটটাই আমরা তৈরি করি। এটির জন্য গ্রহীতাদের ১ হাজার ৪৯০ টাকা খরচ হয়। অতিরিক্ত চাপের কারণে আরও লোকবল বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে।
পান্থপথ আলিফ ব্লাড ব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউসন সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট জাহাঙ্গীর বলেন, হোল ব্লাডটা দিতে পারি কিন্তু ডেঙ্গুর জন্য প্লাটিলেট কাউন্টটা লাগে বেশি। রাখা ব্লাড থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট করা যায় না সেক্ষেত্রে ডোনার বেশি দরকার। ডোনার যে পরিমাণ দরকার সেই পরিমাণ আমরা দিতে পারি না। ডোনার ম্যানেজ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সবার চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্ত নিতে আসা অনেককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এদিকে ফোন করেও অনেকে প্লাটিলেটের কথা বলছেন তাদের কোনো সদুত্তর দিতে পারছি না। এটি শুধু আমাদের না সব ব্লাড ব্যাংকে একই রকম অবস্থা। কারণ বর্তমান চাহিদা অনেক বেশি। ১০ জন রোগীর জন্য ফোন দিলে আমরা ২ জনকে দিতে পারি। তিনি বলেন, পজেটিভ ব্লাডের ক্ষেত্রে একটু কম খরচ হয় কিন্তু নেগেটিভ ব্লাডে বেশি খরচ পড়ে। পজেটিভের ক্ষেত্রে ২৫০০-৩০০০ টাকা লাগে। আর নেগেটিভের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন। বর্তমানে প্রতিদিন ১০-১৫ জন রোগীর জন্য রক্ত চাচ্ছে। এরমধ্যে ২-১ জনকে ব্লাড দিতে পারি।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের ইনচার্জ এসআই এ কে এম সিদ্দিকুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি রক্তের চাহিদা। অ্যাফেরেসিস মেশিনের মাধ্যমে রক্তদাতার রক্ত থেকে প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হচ্ছে বেশি। এই মুহূর্তে এই কিটটি আমাদের কাছে পর্যাপ্ত আছে। আগস্টের প্রথমদিকে খুব সংকট ছিল। কারণ এত বেশি প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল যেটা আমদানিকারকরাও বুঝতে পারেনি ডেঙ্গুতে এত ভয়াবহ অবস্থা হবে। আমাদের পুলিশ হাসপাতালে অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। দৈনিক গড়ে ৮০-৯০ জন ভর্তি হচ্ছে। এদিকে প্লাটিলেটের জন্য দৈনিক ১৫-২০ জন আসছে। একজন ডেঙ্গু রোগীর তখনই প্লাটিলেটের প্রয়োজন হয় যখন ২০ হাজারের নিচে তার প্লাটিলেটের পরিমাণ নেমে যায়।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার রজনীগন্ধা ব্লাড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দেলোয়ার খান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেটের জন্য এত বেশি ফোন আসছে যেটা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একদিকে ডোনারের চাহিদা অন্যদিকে রক্তের প্লাটিলেট। কুর্মিটোলা হাসপাতালে গতকালও ডেঙ্গু আক্রান্ত ৯ বছরের একটা শিশু মারা গিয়েছে প্লাটিলেট কমে যাওয়ায়। তার প্লাটিলেট ৩ হাজারে নেমে এসেছিল। প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর জন্য ২০-২৫টি রিক্যুয়েস্ট আসছে। যারা একটু আর্থিকভাবে অসচ্ছল তারা চারটা ডোনার চাচ্ছে। সেক্ষেত্রে রোগীদের জন্য চারটা ডোনার ম্যানেজ করতে আমাদের খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। একই সময়ে একই গ্রুপের চারজন জোগাড় করাও যাচ্ছে না। গত দুই মাস ধরে ছিল তবে, ২০শে আগস্ট থেকে সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। বর্তমানে প্রত্যেকটি ফোন কলই ডেঙ্গু রোগীর। এখন প্রত্যেক ঘরে ঘরে ডেঙ্গু কে কাকে রক্ত দিবে। যে ডোনার তারও জ্বর আবার যে গ্রহীতা তারও জ্বর। যারা একটু সুস্থ আছেন তারা দেয়ার চেষ্টা করছেন। গতকালও একটা ডোনার কনফার্ম করেছি সকালে কিন্তু বিকালে সে জানায় তার জ্বর এসেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি এক শিশুর জন্য রক্ত খুঁজছিলেন তার মা তাসলিমা বেগম। শিশুটির প্লাটিলেট একেবারে কমে গিয়েছে। ২০ হাজারের নিচে তার প্লাটিলেট। শিশুটির মা তাসলিমা বলেন, মেয়ের জন্য চার ব্যাগ ও পজেটিভ রক্ত প্রয়োজন। চারদিন আগে ডেঙ্গু পজেটিভ এসেছে। রাত থেকে কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকে ফোন দিয়েছি। তিনি যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়ও রক্তের সংস্থান করতে পারেননি।
মোহাম্মদপুর রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. জাহিদুর রহমান বলেন, রক্তের চাহিদা অনেক। প্লাটিলেট তৈরির জন্য ব্লাড বাংকে ত্রিপল ব্যাগ আমাদের নেই এখন। এটি আগে ছিল কিন্তু বর্তমানে এত বেশি ডিমান্ড যেটা ইমপোর্টাররা ইমপোর্ট করতে এবং সাপ্লাই দিতে পারছে না। হয়তো আগামী সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাবো। তবে অ্যাফেরেসিস মেশিনের মাধ্যমে যে প্লাটিলেটটি সংগ্রহ করা হয় সেটির কিট সংকট নেই। তবে ডোনার পেতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাঁধন (স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন) এর কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি ফাহিম হোসেন বলেন, আমরা ডোনার ম্যানেজ করে দেই। বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তের চাহিদা অনেক। অন্য বছরের চেয়ে এই বছরে বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসপাতালসহ আশেপাশে যে হাসপাতালগুলো আছে সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্ত চাচ্ছে। প্রতিদিনই প্রায় ২০-৩০ জনের প্লাটিলেট চাওয়া হয়। এই ২০-৩০ জনের সবাইকে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমান সময়ে অনেক রক্ত দাতাকে রাজি করতে পারছি না। এত পরিমাণ রোগীর চাপ যেটা সহজে সবাইকে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে ডোনারকে ফোন দেয়া হচ্ছে দেখা যাচ্ছে সেও ডেঙ্গু আক্রান্ত। অন্য বছরের চেয়ে এইবার বেশি সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির উদ্যোগে শোক দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা