স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর গ্যাস যাচ্ছে রংপুর বিভাগে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে বগুড়া থেকে নীলফামারীর সৈয়দপুর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে উত্তরাঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গ্যাস সরবরাহে উত্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন ব্যবসায়ীরা। এটি সম্পন্ন হলে ২০১১ সালে রংপুরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রতিশ্রতির বাস্তবায়ন হবে।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, দেশের উত্তর জনপদে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টিসহ বাণিজ্যিক ও অন্যান্য গ্রাহকের গ্যাসের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এক হাজার পিএসআইজি এর ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের দেড়শ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন এবং আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এক হাজার ৩৭৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। ‘বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পটি সরকারি ও গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের কাজের শতকরা ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় দেড়শ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের পথে মাটি পরীক্ষার পর নির্মাণসামগ্রী লাইন পাইপ, ইন্ডাকশন বেন্ড, কোটিং ম্যাটেরিয়ালস, ফিটিংস, পিগ ট্রাপ, বল ভাল্ব, গেট ভাল্বসহ অন্যান্য সরঞ্জমাদি আমদানি করে অধিগ্রহণ করা জমির ওপর রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পে ইপিসি ভিত্তিতে সৈয়দুপুরে একশ এমএমএসসিএফডি (মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফিট পার ডে) ক্ষমতা সম্পন্ন একটি সিজিএস (সেন্ট্রাল গ্যাস সাপ্লাই), রংপুরে ৫০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন একটি টিবিএস (টাউন বর্ডার স্টেশন) এবং পীরগঞ্জে ২০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতা সম্পন্ন একটি টিবিএস স্থাপন করা হচ্ছে।
সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার জায়গীর, বদলীপুকুর বাজার, রংপুর নগরীর দর্শনা এলাকায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের কাজ চলছে। সবুজ ধান ক্ষেতের বুক চিরে যাবে গ্যাস। যন্ত্রের মাধ্যমে সরবরাহ লাইনের পাইপ স্থানান্তরসহ পাইপের সঙ্গে পাইপের সংযোগ স্থাপনে চলছে ঝালাইয়ের কাজ। সেই সঙ্গে পাইপ লাইন স্থাপনে উঁচু-নিচু মাটি সমতল করা হচ্ছে। রাস্তার নিচ থেকে পাইপ নিয়ে যেতে চলছে গর্ত করার কাজ। প্রতিটি স্থানে শতাধিক শ্রমিক একযোগে কাজ করছেন।
পাইপ লাইন সংযোগে নিয়োজিত কর্মী আব্দুল করিম বলেন, উন্নতমানের পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। বন্যার কারণে যেন পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য পাইপের ওপর ইউ আকৃতির ঢালাই করা অবকাঠামো দেয়া হবে। এছাড়া পরবর্তীতে গ্যাস লাইনে সমস্যা হলে সাবসেন্টারের মাধ্যমে সরবরাহ কন্ট্রোল করে ত্রুটি সারিয়ে পুনরায় সচল করার ব্যবস্থা রয়েছে।
জায়গীরের বাসিন্দা করিম মন্ডল বলেন, উত্তরাঞ্চলে গ্যাস না থাকার কারণে স্বাধীনতার ৫০ বছরে কোনো ভারী শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি। ফলে এ অঞ্চলের লাখ লাখ বেকার শিক্ষিত তরুণ ঢাকাসহ দেশের বড় শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। ফলে রাজধানীতে মানুষের চাপও বেড়েছে। এছাড়া ওইসব শহরে জীবন ধারণের ব্যয় বেশি হওয়ায় সঞ্চয় থাকছে না কর্মজীবীদের। সরকার দীর্ঘ ৫০ বছর পর পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করছে।
বলদীপুকুর বাজারের যুবক আনিছুল ইসলাম বলেন, গ্যাস আসছে এটি আশার খবর। আমার দাবি কলকারখানা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত যেন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। কারণ শুধু পাইপ লাইন স্থাপন করলেই কাঙ্খিত উন্নয়ন হবে না।
বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক খন্দকার আরিফুল ইসলাম জানান, করোনার কারণে মালামাল আমদানিতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। বর্তমানে জোরেসোরে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত শতকরা ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়েই বগুড়া থেকে নীলফামারীর সৈয়দপুরে গ্যাস সরবরাহের কাজ শেষ করতে পারবো।
রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন বলেন, রংপুরে শিল্প বিপ্লব ঘটাবে গ্যাস। তাই দ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সরকার সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, কর অবকাশসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করলে বিনিয়োগকারীদের এ অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনে আগ্রহ বাড়বে।
রংপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু বলেন, সারাদেশের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সবচেয়ে দরিদ্র। পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ হলে রংপুর অঞ্চলের আর্থ সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। কলকারখানা স্থাপন হলে সেই দারিদ্রতা দূর হবে বলে আমি মনে করছি। যেহেতু গ্যাস আসছে, তাই সরকারকে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উদ্যোক্তাদের প্লট বরাদ্দ করতে হবে।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস বগুড়া থেকে নীলফামারী জেলায় যাচ্ছে। আমরা রংপুর অংশে জমি অধিগ্রহণ করেছি। সেই সঙ্গে কষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করছি পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ হলে রংপুরে ব্যাপক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। কাঙ্খিত প্রত্যাশা পূরণ হবে এ অঞ্চলের মানুষের।
আরো পড়ুন : গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা ইশরাক