অর্থনৈতিক প্রতিবেদক: বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, কর ফাঁকি এবং কর এড়ানো বা অব্যাহতির কারণে করপোরেট ও ব্যক্তিখাতে বছরে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এসব রাজস্ব আদায় সম্ভব হলে স্বাস্থ্যখাতের বাজেট ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া চলমান অবস্থা থেকে উত্তরণে কর জালের আওতা বৃদ্ধি এবং কর অব্যাহতির প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধে ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশনের আহ্বান জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সোমবার ‘করপোরেট খাতে কর স্বচ্ছতা: বাজেটে সরকারি আয়ের অভিঘাত’ শীর্ষক সিপিডি’র মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। গবেষণাটি যৌথভাবে সম্পন্ন করেছেন সিপিডি ও খ্রিস্টান এইড। ১২ জন অডিটরস ও রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কর অব্যাহতি নির্দিষ্ট সময় ও লক্ষ্যভিত্তিক হওয়া উচিত। আর্থিক খাতের সব লেনদেন সমন্বিত হওয়া দরকার। এ সম্পর্কিত রিপোর্ট ইন্টিগ্রেট হওয়া উচিত।
এর অংশ হিসেবে ডিজিটালাইজেশন ও ইন্টারনেটভিত্তিক ট্রানজেকশন হওয়া উচিত। কর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলক সাসটেইনেবল রিপোর্টিংয়ে যাওয়া দরকার।
দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত ১০ বছরে ৩ গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২৭.২৫ বিলিয়ন টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকা। তবে আদালতের স্থগিতাদেশ আছে এমন ঋণ এবং পুনঃ তফসিলকৃত ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি হবে। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছে সিপিডি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়া, স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশোধনী, আর্থিক ঋণ আদালত আইনের দুর্বলতা, দেউলিয়া বিষয়ে আইনে ফাঁকফোকর, তথ্যের মান নিয়ে সমস্যা, সঠিক তথ্যের অনুপস্থিতি, ঋণ পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য, জাল নথি ও ভুয়া কোম্পানির পরিচয়।
অন্যদিকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি রেজিস্ট্রার্ড হলেও রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানি। এতে প্রতি বছর সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বাজেটে কি পরিমাণ কর ছাড় দেয়া হবে, সে বিষয়ে আগাম ঘোষণার দাবি জানায় সিপিডি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ট্যাক্স জাস্টিস রিপোর্ট বলছে- কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর মাধ্যমে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার কর ক্ষতি হচ্ছে। যার মধ্যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির মাধ্যমে ৩১২ বিলিয়ন ডলার ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে ১৭১ বিলিয়ন ডলার কর ক্ষতি হচ্ছে। এর অভিঘাত পড়ছে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে করপোরেট ট্যাক্স হার কমে আসছে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে বেড়েছে। করপোরেট করহার কমিয়ে কর জাল বাড়িয়ে ট্যাক্স আদায় করা দরকার। করহার বাড়ানোর ফলে প্রচুর কালোটাকা থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে করপোরেট ট্যাক্স রেট দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। কিন্তু ট্যাক্স জিডিপি রেশিও আফগানিস্তানের পরে সর্বনি¤œ। পার্সোনাল ও সেলস ট্যাক্স কম না, কিন্তু সেটা আমরা নিতে পারছি না। উচ্চ করহার দিয়েও এর সুফল আমরা ভোগ করতে পারছি না। আবার কর কমিয়ে দিলেও রাজস্ব বাড়ে, সেটারও নিশ্চয়তা নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় ট্যাক্স জিডিপি রেশিও এবং করহারের মধ্যে ফারাক বাংলাদেশে সর্বোচ্চ।
সিপিডি’র গবেষণায় বলা হয়, ৬৮ শতাংশ মানুষ করযোগ্য আয় করার পরও আয়কর দেন না। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কর দেয়ার যোগ্য হওয়ার পরও কর দেন না। বিপুল পরিমাণ কর আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এটা কিন্তু ট্যাক্স জিডিপি’র ক্ষেত্রে মাথাব্যথার কারণ। কর জিডিপি’র অনুপাত না বাড়ারও বড় কারণ এটি।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার ৩০ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে করের পরিমাণ ছিল ২০১০ সালে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। ছায়া অর্থনীতিতে ৮৪ হাজার কোটি টাকা কর ক্ষতি হচ্ছে। যা জিডিপি’র প্রায় ৩০ শতাংশ। এ টাকা যদি পাওয়া গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় তিনগুণ বাড়ানো যেত। অর্থাৎ করনেট বৃদ্ধির প্রতিবদ্ধকতা হচ্ছে প্রধান অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। বড় অংশই করের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে কর ফাঁকি দিন দিন বাড়ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কর অস্বচ্ছতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কর ফাঁকি ও কর এড়ানো। কর ফাঁকি দিতে গিয়ে কোম্পানি তার প্রকৃত আয় কম দেখিয়ে থাকে। অন্যদিকে কর এড়ানোর বিষয়টি হলো লিগ্যাল ফ্রেমের আওতায় সরকারের দেয়া সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। আমাদের দৃষ্টিতে এটাও কর অস্বচ্ছতা।
কর ফাঁকি ও কর এড়াতে আর্থিক তথ্য গোপনের প্রবণতা বেড়েছে উল্লেখ করে সিপিডি’র এই গবেষণা পরিচালক বলেন, বৈশ্বিক ইনডেক্সে কর ফাঁকি ও কর এড়াতে আর্থিক তথ্য গোপন করার প্রবণতায় ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫২তম। বাংলাদেশ ২০২২ সালে আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ পিছিয়েছে। অর্থাৎ দেশে আর্থিক তথ্য গোপন করার প্রবণতা বেড়েছে।
কর ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজস্ব কর্মকর্তা ও অডিটরদের সঙ্গে কথা বলে যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তা হলো, কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর মাত্রা ব্যাপক। কেউ কেউ বলছেন, ট্যাক্স লস যেটি হচ্ছে কর এড়ানোর জন্য সেটি ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আর কর লস যেটি হচ্ছে কর ফাঁকির জন্য সেটি ১৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, কর ফাঁকি যদি ৮০ শতাংশ হয় তাহলে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। কর ফাঁকি ৫০ শতাংশ ধরা হলে রাজস্ব হারানোর পরিমাণ ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আমাদের ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে কর এড়ানোতে যে ব্যয় হচ্ছে সেটা যদি ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয় তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত যত বড় কর-জিডিপি অনুপাত তত কম বলে হলেও তা পুরোপুরি ঠিক নয় বলে জানানা এই গবেষক। তিনি বলেন, এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে বলা হয়েছে, আর্থিক লেনদেনের যে হিসাব রিপোর্ট হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো হচ্ছে না। সুতরাং রেজিস্ট্রার্ড কোম্পানিরও ইনফর্মাল লেনদেন থাকতে পারে। আবার নন- রেজিস্ট্রার্ড কোম্পানিরও ফর্মাল ট্রানজেকশন থাকতে পারে। সুতরাং ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার ৩০ শতাংশ। কিন্তু তার কর-জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশ। ব্রাজিলের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার ৩৩ শতাংশ। কিন্তু তার কর-জিডিপি অনুপাত ৩২ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বড় হলেও কর প্রশাসন শক্তিশালী, সরকারের আর্থিক কাঠামো এবং রিপোর্টিং ব্যবস্থা যদি শক্ত হয়, তাহলে কর আদায় বাড়ানো যায়।