বাজারে দিনের পর দিন জিনিসপত্রের দাম চড়তে থাকায় খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। এর মধ্যে গেল ছয় মাসে ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। আর ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংস্থাটি বলেছে, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে জিনিসপত্র ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং পণ্যবাজারে অব্যবস্থাপনার কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারে খরচ বেড়েছে গড়ে ১৩ শতাংশ। তবে এ সময় তাদের আয় বাড়েনি। ফলে জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ পরিবার বলেছে, বাড়তি এই খরচ সামাল দিতে তারা খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করেছে।
রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল বুধবার ‘কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ’ শীর্ষক জরিপের ফল সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। দেশের আট বিভাগের নিম্ন আয়ের ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপটি করা হয়েছে ৯ থেকে ১৮ মার্চ। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় আছেন ৪০ শতাংশ মানুষ। জরিপে গত সেপ্টেম্বরের সঙ্গে এ বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনা করা হয়েছে। আগের ছয় মাসের চেয়ে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো এখন কী পরিস্থিতিতে আছে, তা তুলে ধরতে জরিপটি পরিচালিত হয়।
সানেমের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু মাছ-মাংস নয়, অন্যান্য খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টেনেছে দরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম এবং ৮১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবার ডাল, ৫৭ শতাংশ পরিবার আটা এবং ৩৭ শতাংশ পরিবার ভাত খাচ্ছে কম। পাশাপাশি অনেক পরিবার খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিচ্ছে, অর্থাৎ আগের চেয়ে কমদামি খাবার খাচ্ছে। সারাদিন উপোস করেছেন এমন দরিদ্র মানুষের হার ১৮ শতাংশ, ছয় মাস আগে যা ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেড়েছে, না কমেছে– তা তুলে ধরতে এ জরিপ করা হয়নি। মূল্যস্ফীতির চাপে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চাপের সার্বিক চিত্র নীতিনির্ধারকদের সামনে তুলে ধরতেই এই জরিপ।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার ঋণ করে চলছে। বাড়তি আয় না থাকায় ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। ৫৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয়বিমুখ হচ্ছে। তবে জিনিসপত্রের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে আরও ৮৫ শতাংশ পরিবারের মানুষ মনে করে, তাদের ঋণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।
ধারকর্জে চলছে সংসার : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৫ শতাংশ পরিবার ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার নিয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ সুদের দুষ্টচক্রে পড়ে এবং পরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। পরিবার চালাতে অন্য উৎস থেকেও ধার করছে দরিদ্র মানুষ।
এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে। সমবায় সমিতি থেকে ধার করেছে ২৩ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ৩ শতাংশ পরিবার।
মানুষ খাচ্ছেন কম : জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলো বলেছে, ছয় মাস আগে তাঁরা মাসে অন্তত চারবার মুরগি, ৮ বার ডিম, ৬ বার রুই-কাতলা মাছ এবং একবার গরুর মাংস খেত। এখন মাসে মুরগি ২ বার, ডিম ৬ বার, রুই-কাতলা মাছ ৪ বার এবং গরুর মাংস খান না বললেই চলে। খাবারের বাইরেও তাঁরা খরচ কমিয়েছেন। পোশাক-পরিচ্ছদে লাগাম টেনেছে ৯২ শতাংশ পরিবার। স্বাস্থ্যে ৬১ শতাংশ পরিবার খরচ কমিয়েছে। এ ছাড়া ৫৮ শতাংশ পরিবারে পরিষেবা খরচ এবং ৪৫ শতাংশ পরিবার শিশুদের শিক্ষা খরচ সংকুচিত করতে বাধ্য হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এমন পরিবারের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন ২৫ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা ৬ মাস আগে ছিল ১২ শতাংশ। এর মধ্যে শহরে প্রায় ৩১ এবং গ্রামে ২০ শতাংশ পরিবারের মানুষ রয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়।
আগামীতে চলবে কীভাবে : খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ জীবন কীভাবে চলবে– এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল জরিপে অংশগ্রহণকারীদের। ৮৫ শতাংশ পরিবারের মানুষ মনে করেন, আবার তাঁদের ঋণ করতে হবে। ৫৩ শতাংশ পরিবার বলেছে, তাদের পরিবারের কর্মহীন ব্যক্তিকে কাজে নিয়োজিত হতে হবে। ৪১ শতাংশ পরিবার মনে করে, ভবিষ্যতে তাদের ভিক্ষা বা শর্তহীন সাহায্য নিয়ে চলতে হতে পারে। ২৪ শতাংশ পরিবার মনে করে, খরচ কমাতে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হতে পারে। ১৯ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, টিকে থাকার জন্য তাদের সন্তানদের শিশুশ্রমে নিযুক্ত করা লাগতে পারে। জমি বিক্রি করে চলতে হতে পারে বলে মনে করে ১৭ শতাংশ পরিবার। ২৫ শতাংশ বলেছে, তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।
সমাধানে করণীয় : এ জরিপে উঠে আসা সমস্যাগুলোর সমাধানে কিছু পরামর্শ দিয়েছে সানেম। সংস্থাটি বলেছে, মূল্যস্ফীতি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জন্য করের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ধরন। তাই মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আরও গতিশীল করতে হবে। পাশাপাশি আমদানির জন্য খুঁজতে হবে বিকল্প উৎস। খাদ্যপণ্যের দাম নামিয়ে আনতে হবে সহনীয় পর্যায়ে। আরও বিস্তৃত করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
প্রশ্নোত্তর পর্ব : জরিপের ফল নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ড. সেলিম রায়হান ও সানেমের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা। এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম রায়হান বলেন, করোনার পর অনেকেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে আরও সংকটে পড়েছেন তাঁরা। বাজারে হুটহাট জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তবে কেন বাড়ে, সেই কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাজার তদারকির দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের হতে হবে দায়িত্বশীল। সরকারের উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্যের দামের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে। তারা একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। বাজারের এ অব্যবস্থাপনা নিরসনে সরকারকে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে সায়মা হক বিদিশা বলেন, সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ে কাটছাঁট করছে। অনেকে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া আমিষে কাটছাঁটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা তৈরি করবে। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি।
আরো পড়ুন : আজ থেকে চালু হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত ফি নিয়ে বৈকালিক সেবা