বিশেষ প্রতিনিধি: ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ কিছুটা হলেও ইতিবাচক। তবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ বিষয়ে এমন মতামত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ এর খসড়া অনুমোদন হয়। এতে একটি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চারজনের জায়গায় তিনজন এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণসহ তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক খাত সংস্কারে আইন সংশোধনসহ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
আরো পড়ুন : এবার আইন সংশোধন হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ধরতে
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ আংশিক। এক পরিবার থেকে চারজনের জায়গায় তিনজন পরিচালক করলে তাতে তেমন কিছু আসে-যায় না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক ব্যাংকে নানাভাবে একটি গোষ্ঠীর ৬ থেকে ৭ জন প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারপরও আগের মতো দুইজন করলে একটা বার্তা যেত। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এ নিয়ে কিছু বলা হয়নি। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। তিনি বলেন, আইএমএফ ঋণের শর্তের কারণে তড়িঘড়ি করে কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের জন্য আইনে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তার প্রয়োগ কঠিন হবে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে কিছু ইতিবাচক দিক আছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা এবং এক পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা চারজনের জায়গায় সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক নামানো কিছুটা হলেও ভালো। তবে আমাদের এখানে সমস্যা আইনের প্রয়োগ নিয়ে। আবার সুশাসনের অনেক ঘাটতি আছে। এখন অনেক ব্যাংকে বিভিন্নভাবে নিজের অনুগত, নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বা সহপাঠীকে পরিচালক হিসেবে বসানো হচ্ছে। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগেও মামাতো, খালাতো ভাই বা পরিচিতজনকে বসানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন দরকার। স্বতন্ত্র পরিচালক সংখ্যা বাড়াতে হবে। এমন লোককে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে যাঁরা পর্ষদে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। উদ্যোক্তা পরিচালকদের পছন্দের ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি যোগ্য মনে না করে তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে আলাদা লোক বসাতে হবে। এভাবে যাঁকে বসানো হবে তিনি ভূমিকা রাখতে না পারলেও অন্তত পদত্যাগ করে একটা বার্তা দিতে পারবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। বিদ্যমান আইনেও অনেক ভালো ভালো কথা আছে। তবে প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, এক পরিবার থেকে পরিচালক সংখ্যা তিনজনে নামানোর বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু সমস্যা শুধু সেখানে নয়। কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ তাদের বিভিন্ন কোম্পানির নামে শেয়ার কিনে পরিবারের বাইরে থেকে প্রতিনিধি হিসেবে ‘প্রক্সি পরিচালক’ হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বসাচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান নিয়োগ করে কয়েকটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে রাখছে। এ ধরনের পরিচালক নিয়োগ বন্ধের সুস্পষ্ট আইন না করলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। প্রতিনিধি হিসেবে যারা ব্যাংকের পরিচালক বা চেয়ারম্যান হন তাঁরা তাঁদের মালিকের পক্ষে কর্মচারী হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন অনিয়ম করেন। বিষয়টি ঠিক না করে আইন সংশোধন করে কোনো লাভ হবে না।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবার বলতে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী, স্বামী, পিতামাতা, পুত্র, কন্যা, ভাইবোন এবং ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাইকে বোঝায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়। তার আগে এক পরিবার থেকে একই ব্যাংকে সর্বোচ্চ দুইজন পরিচালক থাকার সুযোগ ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি এবং অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা সত্ত্বেও ওই সংশোধনীর মাধ্যমে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। অবশ্য ২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনীতে প্রথমবারের মতো এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ ২ জন পরিচালক থাকার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। এর আগে এ বিষয়ে কিছু বলা ছিল না।