কিংবদন্তির শরীরে ছুরি চালাতে পারবেননা বলে বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেহ গ্রহণ করলনা ঢাকার দুটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
স্টাফ রিপোর্টার : বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। রণাঙ্গণের এই বীর যোদ্ধার প্রতি জানানো হয়েছে অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা। গতকাল রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। জানানো হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার জানাজায় অংশ নেন হাজারো মানুষ। বীর যোদ্ধার প্রতি সম্মান জানাতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষ জানাজায় অংশ নেন। তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আজ শুক্রবার জুমার নামাজের জানাজা শেষে সেখানেই সমাহিত হবেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিজে দেহদানের কথা বলে গেলেও ঢাকার দুটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তার দেহ গ্রহণ করতে চায়নি তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে। তারা বলেছে এই কিংবদন্তির শরীরে তারা ছুরি চালাতে পারবেন না।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছেলে বারিশ চৌধুরী বলেন, আমার বাবার সারাজীবনের ইচ্ছে ছিল তার দেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য দান করা হোক। সন্তান হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা এই আশাটি পূরণ করতে চেষ্টা করেছিলাম।
এ জন্য আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে দেহ দান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই শুনেছি, কেউ নেই যে আমার বাবার লাশে ছুরি লাগাতে পারবেন। সম্মান থেকেই এটি বলা হয়েছে। যখন সম্মান ও ভালোবাসা থেকে বলা হয়েছে কেউ হাত দিতে রাজি নয়, তাই সেটি নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। তাই আজ সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে দাফন করা হবে।
কিংবদন্তি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি সম্মান জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে একটি অস্থায়ী মঞ্চ বানানো হয়। গতকাল সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে কফিনবন্দি তার মরদেহ আসে শহীদ মিনারে। সেখানে আগে থেকেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত হন। তীব্র রোদ আর গরম উপেক্ষা করে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের জনগণ। এ সময় কফিনের পাশে ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী শিরীন হক, মেয়ে বৃষ্টি চৌধুরী, ছেলে বারিশ চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলতাফুনন্নেসা, গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. আবুল কাশেম চৌধুরীসহ পরিবারের সদস্যরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা হিসেবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) হেদায়েতুল ইসলাম। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শ্রদ্ধা জানানো শেষে শোক বইতে স্বাক্ষর করেন। দুপুর ২টার পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় নামাজে জানাজা। দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানাজা পড়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব সৈয়দ এমদাদ উদ্দিন। এর আগে ধানমণ্ডির নিজ বাসভবনে প্রথম এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ শুক্রবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সকাল ১০টায় তার মরদেহ নেয়া হবে সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। বাদ জুমা সেখানে তার চতুর্থ জানাজার পর সেখানেই দাফন করা হবে।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৬ই ডিসেম্বরের পর উপলব্ধি করলেন- মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, তার আরও কাজ আছে। বিশেষ করে দুটি ক্ষেত্রে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অসামান্য অবদান রয়েছে। তার একটি হচ্ছে স্বাস্থ্য, অপরটি শিক্ষা। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে গণবিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছেন। তিনি নারীদের উন্নয়নের জন্যও কাজ করেছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তিনি সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করতেন। আর এটি আমাদের দেশে অনন্য দৃষ্টান্ত। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যত অগ্রসর হবে, ততই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শারীরিক মৃত্যু হলেও তিনি তার কর্মের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকবেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য তার মহান কীর্তিগুলো চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধারণ করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।
ডা. জাফরুল্লাহ শুধু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাই নন, বরং একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন বলে মন্তব্য করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের চিকিৎসক। তিনি একজন সাহসী বীর যোদ্ধার পাশাপাশি একজন খাঁটি বাঙালিও ছিলেন। বর্তমানে আমরা চিকিৎসা সেবার যে আমূল পরিবর্তন দেখছি তার পথিকৃৎ তিনি। জাতির এই বীর সন্তানকে নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছুই আছে।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসাধারণ সাহসী, সৎ, দেশপ্রেমিক, নির্ভীক এবং স্পষ্টবাদী ছিলেন। তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, ওষুধ সবকিছুই ছিল তার বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। তিনি স্বাস্থ্যনীতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি পারেননি। ওটা করতে পারলে বাংলাদেশের সব মানুষই স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারতো। তিনি বলেন, দেশ ও মানুষের জন্য কথা বলতেন তিনি। কখনো পিছপা হতেন না। এ রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে একটি জনগণের রাষ্ট্র, একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, সাধারণ মানুষের একটি সমাজ নির্মাণ করার জন্য সারাটা জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে, বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলাম উল্লেখ করে মহাসচিব বলেন, তার চলে যাওয়া আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি এবং যে স্থান শূন্য হলো সেটি আর কখনো পূরণ হওয়ার নয়।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি আমরা অকৃত্রিম ভালোবাসা জানাই, শ্রদ্ধা জানাই। এমন সন্তান যেন এই জাতিতে আবারো জন্মগ্রহণ করতে পারে। তিনি বলেন, ওষুধ শিল্পের বিভিন্ন কোম্পানি বিদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সুইজারল্যান্ডে ওষুধ বিক্রি করছে। তাদের (সরকার) কি স্মরণ আছে ডা. জাফরুল্লাহর কী অবদান! বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বহু অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও সিরাপ খাইয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতো। সেটার বিরুদ্ধে এরশাদ আমল থেকে ওষুধ শিল্পে ডা. জাফরুল্লাহর অবদান এই জাতি কখনো ভুলতে পারবেন না। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধ করেননি, মুক্তিযুদ্ধের পর সেই যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য। শুধু দেশের ভেতরে নয়, দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল অবিচল। তিনি ওয়ার্ল্ড পিপলস হেলথ অ্যাসেম্বলি তৈরি করে সারা বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য লড়াই করেন।
মাত্রায় নানা বিবেচনায় জাফরুল্লাহ চৌধুরী মানুষের মনে অমর হয়ে থাকবেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যেকোনো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তা দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম, আমাদের সব দ্বিধা কেটে যেতো।
বর্তমান সময়ে তার মতো মানুষ বাংলাদেশে খুবই বিরল উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, তিনি আমাদের বারবার বলতেন লড়াই ছাড়া সমাধানের জায়গা নেই। তাই আগামী প্রত্যেকটা লড়াইয়ে কোনো না কোনোভাবে তিনি উপস্থিত থাকবেন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনী অতুলনীয় এবং অনুকরণীয়। এ রকম একজন মহান ব্যক্তির জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাই।
শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, সিপিবির সভাপতি শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, উপদেষ্টা মঞ্জরুল আহসান খান, গণফোরাম (মন্টু) সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু প্রমুখ।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানাজায় অংশ নেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ।
আরো পড়ুন : শনির আখড়ায় বাসার শৌচাগারে বিস্ফোরণে দগ্ধ স্কুলছাত্রীর মৃত্যু