কীর্তনখোলার এক পাড়ে বরিশাল শহর, অন্য পাড়ে চরমোনাই ইউনিয়ন। এলাকাটি সেখানকার পীর পরিবারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদ দুই দশক তাদের দখলে। পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলনের বরিশাল শহরে সাংগঠনিক শক্তি থাকলেও ভোটে জয়ের ইতিহাস নেই। বিএনপি ভোট বর্জন করায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের আসন্ন মেয়র নির্বাচনে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দলটি। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের পরাজয়কে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে বিএনপির ভোটে জয়ের আশাও করছে।
বরিশাল শহর ও বর্ধিত গ্রামীণ এলাকায় দলীয় প্রতীক হাতপাখার পক্ষে সর্বাত্মক প্রচার চালাচ্ছেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা। ভোটারদের ‘মন জয়ে’ বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনূস আহমাদ অস্বীকার করলেও, ভোট পেতে ধর্মের ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। বিএনপি-অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত বরিশাল শহরের ভোটে ধানের শীষ না থাকায়, হাতপাখা বাতাস পেয়েছে। মনোনয়ন নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগও দ্বিধাবিভক্ত। সমীকরণ পক্ষে থাকলেও হাতপাখার বাতাস শেষ পর্যন্ত নৌকাকে সরিয়ে দিতে পারবে কিনা তা আগামী ১২ জুন ভোটের পরই বলা যাবে।
বিএনপিবিহীন ভোটে গত বছর শহর-লাগোয়া জাগুয়া ইউনিয়নে জয় পেয়েছে হাতপাখা। বাকিগুলোতে হয়েছে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এতে উজ্জীবিত ইসলামী আন্দোলন সিটি নির্বাচনে কোমর বেঁধে নেমেছে। চরমোনাই পীর তথা ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের ছোট ভাই মুফতি সৈয়দ ইসহাক মুহাম্মদ আবদুল খায়েরকে মেয়র প্রার্থী করার পরিকল্পনা ছিল। তিনি বরিশাল জেলা সভাপতি এবং চরমোনাই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। বিএনপি ইসলামী আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ আখ্যা দিলেও চরমোনাই পীরের দলের নেতাদের অভিমত, ধানের শীষ ভোটে না থাকায় নৌকার বিরুদ্ধে হাতপাখার জয় সম্ভব। তাই সৈয়দ ইসহাকের পরিবর্তে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তথা জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমকে মেয়র প্রার্থী করা হয়েছে।
তিনি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সিটি করপোরেশন এবং বরিশাল সদর উপজেলা) আসনে ২৭ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। গত সিটি নির্বাচনেও প্রার্থী ছিলেন। সাদিক আবদুল্লাহ সেবার মেয়র হন। ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভোট বর্জন করায় বরিশাল শহরে হাতপাখার ভোটের প্রকৃত পরিসংখ্যান নেই।
তবে নিজস্ব ভোটের সঙ্গে বিএনপির একাংশের সমর্থন মিলবে বলে আশা দলটির। শায়খে চরমোনাই ফয়জুল করীমেরও একই অভিমত। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর তিনি বলেছেন, ‘দুটি কারণে বিএনপি হাতপাখায় ভোট দেবে। প্রথমত, তারা বলছে সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন নেই। তা প্রমাণে ভোট আমাকে দেবে। অন্যথায় তাদের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয়ত, অন্য প্রার্থীকে (স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির সাবেক মেয়রের ছেলে) ভোট দিলে প্রমাণ হবে, বিএনপি কৌশলে এই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এতে তাদের আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
বিএনপি বলছে, তাদের ভোটাররা সর্বাত্মক নির্বাচন বর্জনের অংশ হিসেবে ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আবু নাসের রহমতউল্লাহর বাড়িও চরমোনাই ইউনিয়নে। হাতপাখার জয়ের সম্ভাবনা নাকচ করে তিনি বলেছেন, নগরীতে হাতপাখার ভোটব্যাংক দুর্বল। বিএনপি সমর্থকদের বড় অংশ ভোট দিতে যাবে না। কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণে একটি অংশ যাবে।
বিএনপির ভোট হাতপাখায় পাওয়ার যে আশা ফয়জুল করীম করছেন তা উড়িয়ে আবু নাসের বলেছেন, মেয়র পদে বিএনপি সমর্থকদের ভোট তিন ভাগ হবে। একভাগ পাবে বিএনপির সাবেক মেয়রের ছেলে কামরুল আহসান রূপন। জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন তাপস কিছু ভোট পাবেন। বাকি যে ভোট হাতপাখায় যাবে, তা ইসলামী আন্দোলনের নিজস্ব ভোটের সঙ্গে যোগ হলেও জিততে পারবে না। এ বক্তব্যে সায় দেন আবু নাসেরের সঙ্গে থাকা বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাঁদের ভাষ্য, ইসলামী আন্দোলন সরকারের ‘বি-টিম’ হিসেবে ১৪ বছর ধরে অবাধে দলীয় কর্মসূচি করতে পারছে।
বরিশালবাসীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে নামা খোকন সেরনিয়াতের অনুসারীরা প্রচার চালাচ্ছেন, নৌকা হারলে সাদিক আবদুল্লাহর আধিপত্য ফিরবে। সরেজমিন ঘুরে আভাস মিলল, সাদিককে ঠেকাতে বিএনপির একটি অংশও খোকন সেরনিয়াবাতের জয় চায়। কিন্তু ঘোর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর নৌকায় ভোট দেবে না। ফলে বিএনপির ভোটের গন্তব্য অস্পষ্ট। দলীয় নির্দেশ অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া কামরুল আহসান রূপনের টেবিলঘড়ি এই ভোট পাবে, তেমন লক্ষণও নেই।
আন্দোলনে পাশে না পাওয়া চরমোনাই পীরে দলের ওপর বিএনপি নাখোশ। দলটির মহানগর শাখার সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক তারিন বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে চরমোনাইর মাহফিলে গিয়েছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। কিন্তু আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বানে সাড়া দেয়নি পীর পরিবার। ২০০১ সালের নির্বাচনের দিন চরমোনাইর হোগলা স্কুল কেন্দ্রে মজিবর রহমান সরোয়ারের ওপর হামলা বিএনপি কর্মীরা ভোলেনি। হাতপাখার প্রার্থী কী করে ধানের শীষের ভোট আশা করেন! নৌকার জয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগও আশাবাদী, বিএনপির ভোট হাতপাখায় যাবে না। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট লস্কর নূরুল হক বলেছেন, মজিবর রহমান সরোয়ারের ওপর হামলার মামলায় হাতপাখার প্রার্থীর কারাদণ্ড হয়েছিল। তাই বিএনপির ভোট তিনি পাবেন না।
সাদিক আবদুল্লাহ বাদ পড়ায় এবার আওয়ামী লীগের ভোটও ভাগ হতে পারে। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত গাজীপুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সব ভোট পায়নি নৌকা। একাংশ মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের টেবিলঘড়িতে গেছে। বিএনপির ভোটও তাঁর বাক্সে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেসব ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে বিএনপি নেতারা জিতেছেন, সেখানে ঘড়ি একচেটিয়া জিতেছে। গাজীপুরে ৪৫ হাজারের বেশি ভোট পাওয়া হাতপাখা-শিবির বরিশালে এর পুনরাবৃত্তি আশা করছে।
অর্ধেকের বেশি ওয়ার্ডে সাদিক আবদুল্লাহর অনুগতরা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। নৌকার প্রার্থীর সাদিকবিরোধী প্রচার এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ প্রবল বিরোধের কারণে হাসানাত পরিবারের অনুসারীদের ভোট হাতপাখায় আসবে বলে আশা করছে ইসলামী আন্দোলন। কাউন্সিলর পদে জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের সমর্থকদের ভোটও মিলবে বলে আশা করছে। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব বলেছেন, কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, যাঁরা ইসলামকে পছন্দ করেন তাঁরা হাতপাখায় ভোট দেবেন।
জয় পেতে নৌকাবিরোধী ভোট একাট্টা করার চেষ্টায় কমতি রাখছে না ইসলামী আন্দোলন। দলের আমিরের নেতৃত্বে ২৩ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করছে। চরমোনাই পীর দলের বরিশাল কার্যালয়ে থেকে তদারকি করছেন।
বরিশাল শহরে ইসলামী আন্দোলনের এত কর্মী নেই। শহরের বাইরে থেকেও জনবল আনা হয়েছে। তবে ইসলামী আন্দোলনের মিডিয়া সেলের সদস্য শরীয়তউল্লাহর দাবি, সক্রিয় কর্মীর পাশাপাশি সমর্থকরাও নেমেছেন। অন্য দলের সমর্থকও যুক্ত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নূরুল হকের অভিযোগ, সাধারণ নারীদের টার্গেট করে হাতপাখার কর্মীরা ধর্মের ব্যবহার করছেন ভোটের প্রচারে। পবিত্র কোরআন ছুঁইয়ে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করানো হচ্ছে। যদিও এর দালিলিক প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছেন এই নেতা।
আরো পড়ুন : সব দলের ক্ষেত্রে মার্কিন ভিসা নীতির সমান প্রয়োগ চান সরকার