অত্যাসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ এবং সুষ্ঠু করার টার্গেটে স্বতন্ত্র ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে ঢাকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। সরকার, বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে চলেছেন তিনি। ওয়াকিবহাল কূটনৈতিক এবং সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সব বৈঠকেই রাষ্ট্রদূত জানা-বোঝার চেষ্টা করছেন মানুষের কাক্সিক্ষত ভোটাধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ কোন ফর্মে নির্বাচন হলে নির্বিঘ্নে ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে পারবেন এবং তাদের রায়ের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটবে? নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও কথা হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানো সম্ভব কি-না? সেই প্রশ্নও উঠছে। তবে নির্বাচনকালীন সরকার যে নামেই হোক তা সরকার এবং বিরোধী- সবপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে এমন কথাও আসছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেজায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। তারা এ দেশে একটি মডেল নির্বাচন চাইছে।
২০১৪ বা ’১৮-এর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার আগে থেকেই এ নিয়ে সরব। সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার আদলে বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র ভিসা নীতি ঘোষণা তারই প্রমাণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে তা বহুবার খোলাসা করেছেন হোয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানে অবিচল রয়েছে বলে সোমবারও জানিয়েছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনএসসি)’র স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন পরিচালক অ্যাডমিরাল জন কিরবি।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে আমরা আমাদের অবস্থানে অবিচল। কংগ্রেসম্যাসদের চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। সেই অবস্থান স্পষ্ট করতেই গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ্য, সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানান ৬ কংগ্রেসম্যান। একইসঙ্গে তারা বাংলাদেশের জনগণ যাতে অবাধ এবং সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণে বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র মতে, ২৪শে মে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে এই ক’দিনে মার্কিন দূত পিটার হাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের এবং প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। তারও আগে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি এবং সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের নিয়ে এক টেবিলে বসে মতবিনিময় করেন।
গতকাল (মঙ্গলবার) ছিল তার এ সপ্তাহের সবচেয়ে ব্যস্ত দিন। ওই দিন সকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে। মধ্যাহ্নে বসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। যেটুকু জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার গুলশানের অফিসে বৈঠকটি হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কাউন্সিলের স্কট ব্রেনডন উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবাধিকারসহ বাংলাদেশের সম-সাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়। সেইসঙ্গে আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে সদ্য যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত স্বতন্ত্র ভিসা নীতির প্রভাব নিয়ে কথা হয়। বাংলাদেশের শ্রম আইনের সংশোধন-সংযোজন এবং পরিমার্জনের বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছে। সূত্র বলছে, বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশামাফিক দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন নিশ্চিতে ভিসা নীতির মতো কঠোর বিষয় আরোপের পর এখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সাধারণের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে রিপোর্ট করতে শিগগির ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন পিটার হাস।
ফখরুলের সঙ্গে বৈঠকে সুষ্ঠু নির্বাচন ও প্রচারণা প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা: বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং প্রচারণা প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন বলে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এক টুইট বার্তায় নিশ্চিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এটি ছিল পিটার হাস এবং বিএনপি মহাসচিবের মধ্যকার একান্ত বৈঠক। অর্থাৎ ওই বৈঠকে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে বিএনপির অন্য কোনো নেতা ছিলেন না। কূটনীতিতে এমন একান্ত বৈঠকের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় ওই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে দুপুর আড়াইটায় রাষ্ট্রদূতের বাসা থেকে বের হন বিএনপি মহাসচিব। জানা গেছে, পিটার হাসের আমন্ত্রণে মির্জা ফখরুল ইসলাম তার বাসভবনে যান।
রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জিএম কাদেরের বৈঠকের বিষয়ে যা জানা গেল: এদিকে দু’দিন আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের মধ্যে বৈঠক হয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এরইমধ্যে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। জাপা চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের রোববার বেলা ৩টার দিকে পিটার হাসের সঙ্গে দেখা করতে তার গুলশানের বাসায় যান। এ সময় কাদেরের সঙ্গে ছিলেন তার বিশেষ দূত মাসরুর মওলা। দলীয় সূত্রের খবর, ওই বৈঠকের মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল নির্বাচন। আগামী নির্বাচনে জাপার অবস্থান কী হবে, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন পিটার হাস। জাপা কী এককভাবে, নাকি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে- তাও জানতে চেয়েছেন রাষ্ট্রদূত। জবাবে জাপার তরফে বলা হয়, ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। তবে গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে জাপা জোটবদ্ধ হতে পারে। আর সেই জোট হবে গণতন্ত্রকামীদের সঙ্গে। অর্থাৎ অতীতের দু’টি নির্বাচনের মতো এবার যে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমন্বয় করে কোনো নির্বাচনী ছকে যাচ্ছে না তা স্পষ্ট করেছেন জিএম কাদের।
ওদিকে ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে জাপা চেয়ারম্যান বলছেন, মনে হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট আন্তরিক। তবে তাদের ভিসা নীতি কতোটা বাস্তবায়িত হয় বা কার্যকর হয়, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আমেরিকার ভিসা নীতিতে জাপা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। যারা নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকেন অথবা নির্বাচনব্যবস্থা প্রভাবিত করতে পারেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের স্বার্থ থাকে। তাদের কারও সন্তান লেখাপড়া করেন, আবার কেউ অবসরে ওই সব দেশে বসবাস করতে চান। তাই কেউই চাইবেন না যে তাদের পরিবার-পরিজন কালো তালিকাভুক্ত হোক। এ কারণেই আসন্ন নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে বা ওই ভোটে অনিয়ম করতে কমপক্ষে একবার হলেও তাদের হাত কাঁপবে।
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, সব রাজনৈতিক দল মনে করে- নির্বাচনব্যবস্থাকে সরকার কুক্ষিগত করেছে। সবাই বিশ্বাস করে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সরকার নির্বাচন করতে চায়। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাকশালের আদলে দেশ চালাচ্ছে ‘আওয়ামী লীগ প্লাস’। জি এম কাদেরের মতে, আওয়ামী লীগ প্লাসের মধ্যে আওয়ামী লীগ, প্রশাসন, পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সবাই রয়েছে। গণতন্ত্রের লেবেল লাগিয়ে দেশে বাকশাল কায়েম করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন তিনি। এ অবস্থায় অবশ্যই নির্বাচনব্যবস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে হবে। রোববার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠকে দুই পক্ষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে দীর্ঘ সময় কথা হয় জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো। তিনি (রাষ্ট্রদূত) জানতে চেয়েছেন, আমি যেসব বক্তব্য দিচ্ছি এবং লেখালেখি করছি, তাতে আমার কোনো সমস্যা বা ঝামেলা হচ্ছে কি-না? কোনো ধরণের চাপে আছি কি-না? জবাবে বলেছি, এখনো চাপ নেই, তবে ভবিষ্যতে তা আসতে পারে।