দ্বিপক্ষীয় সফরে আজ ঢাকা আসছেন যুদ্ধবন্ধু দেশ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। রাশিয়ান কোনো মন্ত্রীর এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মিত্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা থাকলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এটি যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু হয়নি।
প্রেসিডেন্ট বা শীর্ষ নেতৃত্ব তো নয়ই, কোনো কেবিনেট সদস্যও এত বছরে বাংলাদেশ সফর করেন নি! ফলে উভয় দেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক সম্পর্ক ঝালাই তথা বন্ধুত্ব গাঢ় করার বার্তা বিনিময়ে এই ‘রাজনৈতিক সফর’ হচ্ছে বলে মনে করছেন পেশাদার কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এই সফরে উভয় দেশের বোঝাপড়া পোক্ত হবে। যুদ্ধের কারণে অনেকটা কোণঠাসা রাশিয়া। এখন পর্যন্ত মস্কোর বিরুদ্ধে না যাওয়া বাংলাদেশকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পাশে চাইবে তারা।
সেই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ সরকারের ওপর পশ্চিমা যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলায় সরকারও মস্কোর মতো পরীক্ষিত বন্ধুর সহায়তা চাইতে পারে। বৃহস্পতিবার বিকালে জাকার্তা থেকে ঢাকায় পৌঁছাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বিমানবন্দরে অতিথিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন। সন্ধ্যায় হবে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আনুষ্ঠানিক বৈঠক। দ্বিপক্ষীয় ওই আলোচনা শেষ হলে ল্যাভরভের সম্মানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নিবেন সের্গেই ল্যাভরভ।
আনুষ্ঠানিক বৈঠক আর ভোজের মধ্যখানে দুই মন্ত্রী কিছুক্ষণের জন্য গণমাধ্যমের মুখোমুখি হবেন।
পরদিন ৮ই সেপ্টেম্বর সকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরস্থ জাদুঘর পরিদর্শনে যেতে পারেন তিনি। ওই দিন সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হবে। বিকালে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে দিল্লির পথে ঢাকা ছাড়বেন ল্যাভরভ। বিদায়ের আগে তিনি সাবেক সোভিয়েত আমলে বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী রাশিয়ায় পড়াশোনা করেছেন তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর পশ্চিমা চাপে কোণঠাসা রাশিয়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়টি জোর দিচ্ছে। পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্ধুত্ব ঝালাইয়ের পাশাপাশি নতুন বন্ধু খোঁজাও রাশিয়ার অগ্রাধিকার। সে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশকে স্বাভাবিকভাবেই পাশে চাইবে তারা। চিরাচরিতভাবে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নীরব রাশিয়া বছরখানেক ধরে বাংলাদেশের বিষয়ে নিজেদের সরব উপস্থিতির জানান দিয়ে আসছে। সেটি ঢাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মস্কোর নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছে দেশটি।
দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে রাশিয়ার এই খোলস ছেড়ে বের হওয়ার নেপথ্যে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ, সেটি রাশিয়া মোটেও গোপন করছে না। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিবিদদের ভূমিকাকে নব্য উপনিবেশবাদ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ প্রশ্নে এরইমধ্যে সরব রাশিয়া। মস্কো মনে করে, এ ধরনের পদক্ষেপ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’। অবশ্য ঢাকাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘দ্বৈরথের ক্ষেত্র’ বানানোর নেপথ্যে ছিল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা।
এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য খালাস করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে রাশিয়া। রুশ জাহাজটির নাম ছিল ‘স্পার্টা-৩’। সেটি পরিবর্তন করে ‘উরসা মেজর’ নাম দিয়ে রাশিয়া রূপপুর প্রকল্পের পণ্য পরিবহন করছিল। কিন্তু ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে কূটনৈতিক পত্র দেয়ার পর বাংলাদেশ উরসা মেজরকে এ দেশের জলসীমায় ঢুকতে দেয়নি। পরে তৃতীয় দেশে গিয়ে রাশিয়া ওই পণ্য খালাস করতে বাধ্য হয়। ঘটনাটি গত ডিসেম্বরের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের একাধিক কূটনীতিক মানবজমিনকে এই আভাস দিয়েছেন যে, সের্গেই লাভরভের সফরে এই বিষয়টি উঠছে এটা প্রায় নিশ্চিত।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজের তালিকা কেন ঢাকা প্রকাশ করলো সেটিও তারা জানতে চাইতে পারে। সেই সঙ্গে কেন প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলো না, সেটিও তুলতে পারেন। সের্গেই লাভরভ যখন ঢাকায় আসবেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। বিশেষ করে রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মস্কোর দিক থেকে আলোচনার আভাস মিলেছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ঢাকা-মস্কো সম্পর্ক জোরদার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের প্রসঙ্গগুলো আসবে।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সইয়ের অপেক্ষায় থাকা প্রায় ২০টির মতো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সইয়ের অপেক্ষায় থাকা ২০টির মতো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে অন্তত চারটি চুক্তি প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত। এর মধ্যে রয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত গোপনীয় তথ্য বিনিময়, প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কারিগরি বিষয়ে মেধাস্বত্ব অধিকার, প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ। দুই দেশ বন্দি প্রত্যর্পণ, কারাবন্দিদের হস্তান্তর, মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারসহ অন্তত ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে কয়েক বছর ধরে আলোচনা চলছে।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় লাভরভের সফরটিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক। তার মতে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বৈশ্বিকভাবে রাশিয়ার প্রভাব এবং গুরুত্ব দুটিই কমেছে। আবার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়া। পশ্চিমাদের চাপের মুখে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে বাংলাদেশ কীভাবে তুলে ধরে, সেটিই দেখার বিষয়। উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের ঢাকা আসার কথা ছিল। সফরটি একেবারে শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যায়।
আরো পড়ুন : স্বজনেরা হন্যে হয়ে ঘুরছেন রক্তের জন্য, হিমসিম খাচ্ছে ব্লাড ব্যাংকগুলো