দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন অপেক্ষা শুধুই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার। নির্বাচন কমিশন বলছে, নভেম্বরের শুরুতে তফসিল দিয়ে ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতে ভোট করার কথা।
এদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে চোখ ইসির। সব দলকে নির্বাচনে আনতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পরের অনেক কাজও এবার আগেভাগে শেষ করছে সাংবিধানিক এ সংস্থটি। ইতোমধ্যে ভোট কেন্দ্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। নির্বাচনী মালামালও কেনাকাটা প্রায় শেষ দিকে। নভেম্বরের মধ্যেই সব মালামাল ইসির হাতে এসে পৌঁছবে। অক্টোবরেই নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। ভোটে অধিক সংখ্যক বিদেশি পর্যবেক্ষক আনতে যোগাযোগ চলছে। বাড়ানো হচ্ছে স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যাও। ৩০০ আসনের আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা ২ নভেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে। এ ছাড়া অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা, যাচাই-বাছাই, ভোটার নম্বর ও ভোট কেন্দ্র জানার জন্য নির্বাচনী অ্যাপ প্রস্তুত রয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে উদ্বোধন করা হবে।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণের তারিখ পর্যন্ত ৬০-৭০ দিন হাতে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং রিটার্নিং অফিসার থেকে সব পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তাদের কর্মকান্ড সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য এবারে বেশি সময় দেওয়া হবে। ইসির হিসাব অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আর ১০০ দিনের মতো সময় আছে।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন নভেম্বরের ১-২ তারিখের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করতে চাইছে। এক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার পরে ভোট গ্রহণের জন্য ৬০-৭০ দিনের বেশি রাখার চিন্তা করছে। বিদেশি পর্যবেক্ষক আনতে ‘বড়দিনের’ কাছাকাছি সময়ে ভোটের তারিখ না দেওয়ার চিন্তা চলছে। এ জন্য ইসি জানুয়ারিতেই ভোট গ্রহণের তারিখ রাখার পরিকল্পনা রাখা হচ্ছে।
প্রথা অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখের আগে ৪০-৪৫ দিন সময় রেখে তফসিল ঘোষণা হয়। এক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহারের সময় ও প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারের জন্য সময় রাখা হয়। প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ, মনোনয়নপত্র জমায় ১০-১৫ দিন, বাছাইয়ে চার দিন, আপিল নিষ্পত্তিতে চার থেকে সাত দিন, প্রত্যাহারের জন্য সাত দিন সময় দেওয়া হয়। তবে এবারে সব দলের অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনী কাজ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য কমিশন বেশি সময় দিতে চাইছে।
সংসদ নির্বাচনের তফসিল দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেন, তফসিল ঘোষণার দিনক্ষণ নিয়ে কমিশন এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা জানুয়ারির শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে বলে আশা করা যায়। আমরা ঐকান্তিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি একটা গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। আশা করছি সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
ইসি আহসান হাবিব বলেন, সংসদ নির্বাচনের তফসিলে সচরাচর যে সময় দেওয়া হতো এবার তা থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টি আলোচনায় আছে। বিশেষ করে রিটার্নিং অফিসারসহ অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সব কর্মকান্ড ও প্রশিক্ষণ এবং প্রার্থীদের আপিল/শুনানিতে তাড়াহুড়া না করে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ধাপে ধাপে যুক্তিযুক্ত সময় দেওয়া এবং বাস্তবতার নিরিখে কার্য সুসম্পন্ন করতে যত সময় লাগবে তা নির্ধারণ করে তফসিল চূড়ান্ত করবে নির্বাচন কমিশন। তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রায় শেষের দিকে। নির্বাচনী মালামালও কেনাকাটা চলছে। যথাসময়ে সব মালামাল ইসির হাতে পৌঁছবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, আগামী নভেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণ আমাদের (নির্বাচন কমিশনের) ওপর নির্ভর করে না। দল অংশগ্রহণ করা নির্ভর করে দলের সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তারা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করেন।
নির্বাচনী সামগ্রী কেনাকাটার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু স্ট্যাম্প প্যাড ছাড়া বাকি সব নির্বাচনী সামগ্রী টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে। কিছু কিছু করে মালামাল আসতেও শুরু করেছে। নভেম্বরের ৭ তারিখের মধ্যে সব মালামাল পেয়ে যাব। ব্যালট পেপারের জন্য ইতোমধ্যে বিজি প্রেসকে বলা হয়েছে। বিষয়টি বিজি প্রেস দেখছে।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারে অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচনী কার্যক্রমে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ ও প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধাদান ঠেকাতে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে জামানতের টাকাও পরিশোধের সুযোগ থাকবে। অন্যদিকে ভোট কেন্দ্রের নাম ও ভোটার নম্বর খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি কমাতে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর এই অ্যাপ উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই অ্যাপে ভোটারের তথ্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, ডিসি, এসপি, ওসিসহ নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের পরিচয়, ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে ৬০ দিন, দ্বিতীয়ে ৫৪ দিন, তৃতীয়ে ৪৭ দিন, চতুর্থে ৬৯ দিন পঞ্চমে ৭৮ দিন, ষষ্ঠে ৪৭ দিন, সপ্তমে ৪৭ দিন, অষ্টমে ৪২ দিন, নবমে ৪৭ দিন, দশমে ৪২ দিন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪৬ সময় হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা হয়েছিল। বাংলাদেশে প্রথম থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে যথাক্রমে- ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ, ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ সালের ৭ মে, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সর্বশেষ নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ও ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর।