মার্কিন ভিসা নীতি কার্যকর হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় রীতিমতো তোলপাড় চলছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে। প্রথম ধাপে কারা এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েছেন তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসছে নানা তথ্য। মার্কিন দূতাবাস অবশ্য এটা স্পষ্ট করেছে যে, ভিসা সংক্রান্ত তথ্য একান্তই দূতাবাস এবং ভিসা আবেদনকারীর মধ্যে বিনিময় হয়। যুক্তরাষ্ট্র কঠোরভাবে গোপনীয়তা রক্ষার ওই সবর্জনীন নীতি মেনে চলে। যারা এরইমধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন তাদের লিখিতভাবে তা অবহিত করা হয়েছে। এখানে তৃতীয় কারও এমনকি সরকারকেও ‘ব্যক্তির ভিসা সংক্রান্ত গোপনীয় তথ্য’ শেয়ারে বাধ্যবাধকতা নেই দূতাবাসের।
একাধিক ব্যাখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের তরফে জানানো হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অযাচিত হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ সাপেক্ষে পূর্ব-ঘোষিত ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু হয়। ২০১৪ এবং ’১৮ এর প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে পরবর্র্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির মতো কঠোর ওই নিষেধাজ্ঞা জারি করে গত মে মাসে। সে সময় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ২১২ (এ) (৩) (সি) (‘৩সি’) ধারার অধীনে বাংলাদেশের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে (স্বতন্ত্র) ভিসা নীতিটি গ্রহণ করেছে বাইডেন প্রশাসন।
সেই আইনের ব্যাখ্যায় বিশ্লেষকরা বলছেন, যে ‘থ্রি সি’ নীতির অধীনে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ওয়াশিংটন তার প্রভাব রয়েছে প্রজন্মান্তরে। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া ব্যক্তির সন্তান এবং পরিবারের সদস্যদেরও এর ঘানি টানতে হবে যুগের পর যুগ।
আইনটি এতোটাই শক্ত যে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে জীবনভর এর মাশুল গুনতে হবে! ওয়াশিংটনের তরফে খোলাসা করেই বলা হয়েছে, ওই ভিসানীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করবে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত। গত ৩রা মে বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় বলে পূর্বের ঘোষণায় নিশ্চিত করা হয়। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র সম্প্রতি ভিসানীতির প্রায়োগিক ধারা ‘৩সি’র ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ভয়েস অফ আমেরিকার এক প্রশ্নের জবাবে “থ্রি সি” নামক ভিসানীতিটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ক্ষুণ্ন্ন করে এমন- ‘যেকোনো ব্যক্তির’ ওপর প্রয়োগ হতে পারে বলে জানান মুখপাত্র। দূতাবাসের ব্যাখ্যায় বলা হয় থ্রি সি ধারায় গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি হলো ‘যেকোন ব্যক্তি’। আইনে বলা হয়, অভিযোগ প্রমাণিত হলে এমন ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে দুর্বল করে এমন কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, জনসাধারণকে সংগঠনের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখার জন্য সহিংস আচরণ এবং রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বা তাদের মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখার জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ। অতি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গণমাধ্যমসহ যে কোনো সেক্টরে ওই ভিসানীতি প্রয়োগ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। গত ২২শে সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মিলার বলেন, “শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করতেই এ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে আগ্রহীদের সমর্থন করতে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত অঙ্গীকারের অংশ এটি।” ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপের মধ্যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন জানিয়ে মিলার বলেন, “বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র; যাতে এটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়।” মুখপাত্র জানান, “নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন ব্যক্তি ও তাদের নিকটতম স্বজনরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এর আগে চলতি বছরের ২৪শে মে এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, “আজ, আমি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ২১২ (এ) (৩) (সি) (‘৩সি’) ধারার অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করবে।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। সাধারণত কোনো দেশ আরেকটি দেশকে বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বা অন্য নিষেধাজ্ঞার প্রতি তার বন্ধু দেশগুলো সম্মান দেখায়। তারা তা মানতে বাধ্য নয়, তবে কানাডা, বৃটেন, জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করে থাকে। ফলে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো ভ্রমণে বাধার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই সব দেশে ওই ব্যক্তির যাতায়াত, বিনিয়োগ বা স্বার্থ ক্ষুণ্ন্ন হতে পারে। নিষিদ্ধ ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ তো নয়ই, ওই দেশের সঙ্গে কোনোরকম লেনদেন বা সম্পর্কও রক্ষা করতে পারেন না। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক রাখতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অর্থ-সম্পদ সেটি মার্কিন কোনো ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জব্দ হতে পারে।
আরো পড়ুন : গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি না পাবার কারণে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ