জেনে নিন কোন কোন উদ্যোগে কমানো সম্ভব ঢাকার যানজট

জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ মুক্তমত

আলী আকবর মল্লিক: ঢাকার অসহনীয় যানজট নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা অচল নগরী হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মেট্রোরেল, বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট, এলিভেটেড ওয়ে নির্মাণ—দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। জরুরি কিন্তু স্থায়ী পরিকল্পনায় ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকেরা গাড়ি ছেড়ে যাতে বাস ব্যবহার করেন, তেমন গতিশীল ও উন্নতমানের বাস সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন। এর বিকল্প পথ নেই। ব্যক্তিগত গাড়িতে কর্মস্থলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা সীমিত করতে হবে, শুধু মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি ছাড়া।

দুজন সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তা দুটি গাড়ি নিয়ে সড়কের যে জায়গা দখল করেন, সেখানে একটি বাস দাঁড়াতে পারে ৬০ জন যাত্রী নিয়ে। সুতরাং প্রাইভেট গাড়ি বা জিপ সড়কে বের করে যানজট কমানো সম্ভব নয়। এসব কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত বাস থাকবে, তার জোগান দেবে বর্তমানে ঢাকায় চালু বাসগুলোর মধ্যে ভালো মানের বাসগুলো। আবার দেখা যায় প্রাথমিক স্তরের সন্তানদের স্কুলে যাওয়া-আসার কাজটি মা-বাবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করেন। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এই প্রবণতাটা বেশি। স্কুলের আশপাশে মায়েদের সর্বক্ষণ ভিড় করতে দেখা যায়। কত মায়ের কত ঘণ্টা যে নিষ্ক্রিয়ভাবে ব্যয় হয়, তার হিসাব নেই। এমন দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এর অবসান হওয়া দরকার। ঢাকার যানজট নিরসনে যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা আলোচনা করছি।

এক. বাস মাস ট্রানজিট (বিএমটি) বা অন্য কোনো নামে একটি বাস কোম্পানি করতে হবে। ঢাকায় যেসব বাস বর্তমানে চলছে, তার ৩০ শতাংশের অবস্থা মোটামুটি ভালো। সরকারি ও বেসরকারি অফিসের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোকজনের জন্য যতগুলো বাস দরকার, তা এই ভালো বাসগুলোর মধ্য থেকে পূরণ করতে হবে। এই বাস ছাড়া আর যত বাস আছে, তা ঢাকার বাইরে আন্তজেলা পর্যায়ে চলবে। সব বাসের মালিকেরা তাঁদের বাসের মূল্যমানের সমমূল্যের শেয়ারের (ঢাকার নতুন বাসের) মালিক হবেন। ব্যবস্থা করবে বিএমটি।

দুই. বিএমটি পাঁচ হাজার উন্নত মানের শতভাগ নতুন এসি বাস কিনবে। নিম্নমানের বাস কিনলে এই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়বে বলে বাসগুলো হতে হবে স্ক্যানিয়া, ভলভো ও মার্সিডিজের। বাসগুলোর পেছনের ২৫ সিট গ্যালারি সিস্টেমের। সামনের ২০ সিট সমতল যেখানে মহিলা, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার থাকবে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে ২০-২৫ জন যাত্রী। সর্বমোট ৬৫ জন। ডাবল ডেকারের ক্ষেত্রে ৮০-১০০ জন। বাসের সামনে থাকবে ওঠার ও মাঝ বরাবর থাকবে নামার দরজা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ইউনিফর্ম পরিহিত চালক ছাড়া কোনো সহকারী বাসে থাকবে না। ওয়ান ম্যান বাস সার্ভিস। এমন বাস সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, বেইজিং, নয়াদিল্লিতে দেখা যায়। ঢাকার মধ্যে একটি ভাড়া নির্ধারণ করলে ভালো হয়। এক, তিন ও ছয় মাসের পাস (নন-ট্রান্সফারেল) থাকবে। পাসধারীরা যতবার ইচ্ছা ততবার যেকোনো জায়গা থেকে উঠতে ও নামতে পারবে। এ ছাড়া প্রতি স্টপেজে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। এ ধরনের পাঁচ হাজার বাস কিনতে লাগবে ১০ হাজার কোটি টাকা।

ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, গতিশীল বাস সার্ভিস চালু ও ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ করা ছাড়া ঢাকার যানজট মুক্ত করা সম্ভব নয়। কারণ, সমস্যার মূলে হলো কর্মজীবীদের ও শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ কর্মস্থলে ও স্কুলে পাবলিক যানবাহনে না গিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে সড়কে নেমে পড়া। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশ লোক বেশির দেশের রাজধানীতে মূল মন্ত্র হতে হবে কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণপরিবহনে যাতায়াত।

তিন. বিএমটি বাসস্টপেজ, লে-বাই, রাস্তা প্রশস্তকরণ ও নতুন কয়েকটি বাস ডিপো নির্মাণ করবে। সব বাসচালককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ জন্য ব্যয় হবে আনুমানিক পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

চার. বর্তমানে যাঁরা বাসগুলো সড়কে চালাচ্ছেন, তাঁদের বিএমটি নতুন পাঁচ হাজার বাসের শেয়ার দেবে। তাদের বর্তমান বাসের মূল্য নির্ধারণ, সেই বাসের ভবিষ্যৎ মালিকানা, সরকারি বা বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোকজনের সার্ভিস, আন্তজেলায় বাসগুলোকে ট্রান্সফার ইত্যাদি বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন বিএমটি করবে। এ বিষয়ে মালিকদের ভর্তুকি দিতে হবে বাসগুলোকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বর্তমানের বাসগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য খরচ হতে পারে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

এ চারটি কাজের জন্য যে খরচ হবে তা পদ্মা সেতু প্রকল্পের তিন ভাগের দুই ভাগ। ঢাকায় যে ছয়টি মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার যেকোনো একটির নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে এই ব্যয় অনেক কম। ছয়টি মেট্রোরেল নির্মাণ শেষ হওয়ার পরও এই বাস সার্ভিস একই হারে প্রয়োজন হবে, কারণ একটি রাজধানী শহরের বাস সার্ভিস হচ্ছে একটি সহজ ও সর্বসাধারণের যানবাহন। ঢাকার পরিবহন সামাল দিতে মেট্রোরেল ও বাস দুটোই লাগবে যাতায়াতে গতিশীলতার জন্য।

২০ বিঘা জমি নিয়ে ঢাকার অদূরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয় ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমানের মিরপুরে থাকা বিআরটিএ যুগোপযোগী নয়। যেকোনো হালকা বা ভারী বাহন চালানোর পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে গবেষণাগার। দেশের কোথায় কী কারণে কতটা দুর্ঘটনা ঘটল, তার হিসাব থাকবে। লাইসেন্সের পুরো প্রক্রিয়া হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনির মতো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চালকদের লাইসেন্স প্রদান করতে হবে, ডান হাত বাঁ পাশের হৃৎপিণ্ডের ওপর রেখে শপথবাক্য পাঠ করার পর। সঙ্গে বাজবে জাতীয় সংগীত। লাইসেন্সের মূল্যমান থাকবে ১০০। অপরাধ অনুসারে মূল্যমান কাঁটা যাবে। ৩০-এর নিচে নেমে এলে আবার নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে।

এর সঙ্গে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। জেলা বা উপজেলায় চাকরি করে অথচ পরিবার থাকে ঢাকায়, এর সংখ্যাই বেশি। এর অন্যতম কারণ, জেলা পর্যায়ে ঢাকার মানের স্কুল না থাকা। ঢাকার একটি করে নামকরা গার্লস স্কুল ও বয়েজ স্কুলের শাখা প্রতি জেলায় থাকা দরকার। সেটা বর্তমানে জেলা শহরে থাকা স্কুলের পাঠ্যক্রম ঢাকার স্কুলের আদলে করা যেতে পারে। প্রত্যেক শ্রেণির ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষা হবে একই দিনে ও একই প্রশ্নপত্রে।

ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, গতিশীল বাস সার্ভিস চালু ও ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ করা ছাড়া ঢাকার যানজট মুক্ত করা সম্ভব নয়। কারণ, সমস্যার মূলে হলো কর্মজীবীদের ও শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ কর্মস্থলে ও স্কুলে পাবলিক যানবাহনে না গিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে সড়কে নেমে পড়া। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশ লোক বেশির দেশের রাজধানীতে মূল মন্ত্র হতে হবে কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণপরিবহনে যাতায়াত।

ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ

আরো পড়ুন : দাম কমল তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের; ১২ কেজি সিলিন্ডার ১ হাজার ৩৩৫ টাকা

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *