সিলেট ব্যুরো: আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হচ্ছে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। দৃষ্টিনন্দন এ বাস টার্মিনালের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে বদলে যাবে সিলেট নগরীর কদমতলী এলাকার দৃশ্যপট। ভোগান্তি অনেকটা কমে যাবে যাত্রী, পথচারী ও ব্যবাসয়ীদের। ময়লা আবর্জনার ভাগাড় অনেকটা পরিস্কার হয়েছে টার্মিনাল এলাকার। টার্মিনালে বাতাস চলাচলের জন্য তারের জালি ও লুভ ব্যবহার করা হয়েছে এবং রাখা হয়েছে গ্রীণজোন। প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ টার্মিনালের নির্মাণ কাজ আগামী জুন মাসে শেষ হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। সরেজমিনে ঘুরে ও সংশি¬ষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় ময়লা আবর্জনার ভাগাড় নগরীর দক্ষিণ সুরমার কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ছিল। যার কারণে সবসময় এ এলাকার অনেকাংশে দূর্গন্ধ থাকতো। যাত্রী, পথচারী ও ব্যবাসয়ীদের জন্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিল। এ স্থানেই নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাস টার্মিনাল। উপরে ইট রং এর স্টিলের টিনের ছাদ, কারুকার্যময় লাল ইটের দেয়াল, গাছপালা আবৃত গ্রীণজোন, বিমানবন্দরের আদলে আলাদা বাস ডিপারচার ও অ্যারাইভাল এবং যাত্রীদের জন্য প্রায় ১৫শ’ সিটের বিশাল ওয়েটিং লাউন্সের সুবিধা রয়েছে এ টার্মিনালে। নির্মাণ কাজের সাথে সংশি¬ষ্টরা জানান, পুরো টার্মিনালের নির্মাণ কাজ তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে পার্ট-১-এ অবস্থিত ডিপারচার বিল্ডিংয়ের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩শ’ ফুট। এই পার্টে ৪৮টি ‘বাস বে’র সাথে রয়েছে ৯৭০ সিটের যাত্রী বসার সুবিধা সম্পন্ন বিশাল হল। রয়েছে ৩০ সিটের ভিআইপি কক্ষ, ৩০টি টিকেট কাউন্টার ও ৫০ জন মুসল্ল¬ী ধারণ ক্ষমতার নামাজ কক্ষ। পুরুষ মহিলাদের পৃথকসহ প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী ৬টি টয়লেট জোন। হুইল চেয়ার নিয়েও যে কেউ টয়লেট ব্যবহার করতে পারবেন। উপরে উঠার জন্য রয়েছে-লিফ্ট এবং খাবারের জন্য রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট। থাকবে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া যাত্রীর জন্য সিক বেড, দুগ্ধপোষ্য শিশুদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং জোন।
পার্ট-২-এ এরাইভাল বিল্ডিং-এ একই ভাবে প্রায় ৩শ ফুট দৈর্ঘ্যের। ডিপারচার বিল্ডিং এর মতো এখানে রয়েছে বাস বে, যাত্রীর বসার জন্য ৫১০ সিটের ওয়েটিং স্পেস ও ৩০ সিটের ভিআইপি কক্ষ, আধুনিক টয়লেট সুবিধা, সিক বেড, ব্রেস্ট ফিডিং জোন, লিফ্ট, রেস্টুরেন্টসহ যাত্রীদের সকল সুযোগ সুবিধা। পার্ট-১ ও পার্ট-২ এর মাধ্যমে ডিপারচার ও এরাইভাল আলাদা করা হলেও করিডোরের মাধ্যমে পুরো স্ট্রাকচার একটি সার্কুলার বিল্ডিং-এ পরিণত হয়েছে। এই বিল্ডিং এর পশ্চিম-দক্ষিণ কর্ণারে সড়কের সাথে গোলাকার ৫ তলা টাওয়ার বিল্ডিং-এ রয়েছে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অফিস। যেখানে থাকবে পুরো টার্মিনালের সিকিউরিটি কন্ট্রোল ও সিসিটিভি মনিটরিং কক্ষ, পুলিশ কক্ষ এবং পর্যটন অফিস।
টার্মিনালের পিছনের দিকে পার্ট-৩-এ নির্মিত হয়েছে একটি মাল্টিপারপাস ওয়েলফেয়ার সেন্টার। যেখানে মালিক ও চালক সমিতির জন্য থাকবে ২৪ বেডের বিশ্রাম কক্ষ, গোসলের ব্যবস্থা, অফিস, লকার ব্যবস্থা, ক্যান্টিন এবং মিটিং ও অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল মাল্টিপারপাস মিলনায়তন।
সংশি¬ষ্টরা জানান, বিশ^ ব্যাংকের অর্থায়নে এমজিএসপি (মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট সার্ভিস প্রজেক্ট) প্রকল্পের আওতায় সিলেট সিটি কর্পোরেশন ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে ৮ একর জায়গা জুড়ে নির্মাণ করছে নতুন বাস টানির্মাল কমপে¬ক্স। ৬ তলা ভিত্তির ৩ তলা কমপে¬ক্স প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ডালি কনস্ট্রাকশন। ডালি কনস্ট্রাকশন এর সিনিয়র প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন জানান, প্রকল্পের প্রতিটি কাজ অত্যন্ত যতœ সহকারে করা হচ্ছে। উপরের স্টিলের টিন আনা হয়েছে তাইওয়ান থেকে। স্ট্রীল স্ট্রাকচারের জন্য লোহার বার আনা হয়েছে চায়না থেকে এবং প্রতিটি জিনিস বুয়েটে টেস্ট করা হয়েছে। বিমানবন্দরের আদলে বিশাল ওয়েটিং স্পেস রাখা হয়েছে। আছে পার্কিং জোন, পরিবেশের কথা বিবেচনা করে ভবনের পিছনের দিকে থাকবে গাছপালা আচ্ছাদিত গ্রীণজোন। পরিবহন শ্রমিকদের জন্য মাল্টিপারপাস বিল্ডিং এ থাকবে বিশাল হল রুম, অফিস, ওয়াশরুম, রেস্ট রুমসহ বিভিন্ন সুবিধা। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের হলেও করোনার কারণে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ ছিল বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সিলেট টার্মিনাল এখন দেশের অন্যতম সুন্দর একটি স্থাপনা। চট্টগ্রাম বাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য তাদের বিশেষজ্ঞরা নবনির্মিত সিলেট টার্মিনাল দেখে এর প্রশংসা করেছেন। এলজিইডির উর্ধ্বতন প্রকৌশলীরা এসেও অভিভূত হয়েছেন। নতুন এই টার্মিনালের নক্সা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের(শাবিপ্রবি) আর্কিটেকচার বিভাগের ৩ সহকারী অধ্যাপক যথাক্রমে সুব্রত দাশ, রবিন দে এবং মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। এটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন বাস টার্মিনাল হবে। প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ টার্মিনালের নির্মাণ কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলামসহ মন্ত্রণালয়ের একাধিক টিম প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন বলে জানান তিনি।
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়য়ে তদারকি করতে সিটি কর্পোরেশন তাদের লোক দিলে ভালো। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমিতির পক্ষ থেকেও বিষয়টি তদারকি করা হবে। টার্মিনাল চালুর পূর্বে সিটি কর্পোরেশন মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে বসে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিলেট জেলা বারের আইনজীবি এডভোকেট মামুন রশিদ বলেন, সিলেটে দৃষ্টিনন্দন আধুনিক বাস টার্মিনাল নির্মাণ সরকারের দৃশ্যমান অগ্রগতির একটি নিদর্শন। দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন, বিমানবন্দরের আদলে এরাইভাল ও ডিপারচার ব্যবস্থা, মা ও শিশু, রোগী ও প্রতিবন্ধীদের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। সিলেট এমন একটি স্থাপনা নির্মিত হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রী, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি কর্পোরেশনসহ সকলের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।
কাওসার আহমদ, সিলেট ব্যুরো
আরো পড়ুন : চরম শ্রমিক সংকটে ভোলাহাটে কৃষক বিপাকে