নিবন্ধনহীন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্হ্যসেবা কেন্দ্রগুলো ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বুধবার অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরের সভাপতিত্বে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. বিল্লাল হোসেন বলেন, যেসব ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স নেই, তিন দিনের মধ্যে সেগুলো বন্ধ করা না হলে আইনানুগ ব্যবস্হা নেওয়া হবে। অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে রাজধানীতে স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের নিজস্ব মনিটরিং টিম থাকবে। ঢাকার বাইরে জেলা সিভিল সার্জনদের নেতৃত্বে বিষয়টি তদারক করা হবে।
রাজধানী অলিগলি থেকে শুরু করে সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যন্ত হাজার হাজার ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে অনুমোদন ছাড়াই। দীর্ঘদিন মানহীন এসব ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিত্সার নামে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রমরমা বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ে পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এমনকি ভুল চিকিত্সা ও ভুল রিপোর্টে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অনেককে। অনেক রোগীর জীবনও চলে যাচ্ছে ভুল চিকিত্সায়।
সারা দেশে বৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে প্রায় ১১ হাজার। অবৈধ আছে কত, তার সঠিক তথ্য নেই। অধিকাংশ হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক চালু করে তারপর অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন। এই আবেদন দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্হ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে পড়ে থাকে।
কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী আগে অনুমোদন নিতে হবে, তারপর অবকাঠামো তৈরি করবে। স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের টিম সরেজমিন গিয়ে দেখবে অনুমোদন দেওয়া যাবে কি না। এরপর অনুমোদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে চালু হওয়ার কথা। অনেকে অনুমোদন না নিয়ে ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু করে চিকিত্সার নামে বাণিজ্য শুরু করেছে। একই সঙ্গে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এসব অবৈধ স্বাস্হ্য কেন্দ্রে সিজার করতে গিয়ে মা ও সন্তান মারা যান।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ভুল সিজারের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব রোগী এই হাসপাতালে আসে, বেশির ভাগেরই সিজারে ত্রুটিপূর্ণ। কোনো কোনো গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেন, ৮০ থেকে ৮৫ ভাগেরই সিজারে ত্রুটি আছে। অনেক ক্লিনিক ও হাসপাতালে মানসম্পন্ন অপারেশন থিয়েটার নেই, অজ্ঞানকারী চিকিত্সক নেই। সেখানেও সিজারে হয়েছে বলে রোগীর অভিভাবকরা জানান।
এদিকে অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালনার সঙ্গে স্বাস্হ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্হ্য), সিভিল সার্জন ও উপজেলা পর্যন্ত একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এইসব প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে নির্ধারিত হারে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। নিয়মিত মাসোহারা পাওয়ার কারণে এতসব ত্রুটি থাকার পরও অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ হচ্ছে না। অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে বছরের পর বছর।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্হ্য অধিদপ্তর—এটা মহৎ উদ্যোগ। অভিযান শুরু হয়েছে। কতটুকু সফল হবে সেটা সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। এই ধরনের নির্দেশনা অতীতেও বহুবার অধিদপ্তর থেকে জারি করা হয়েছে। কিছু দিন অভিযান চালিয়ে, পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।
একাধিক অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের মালিক স্হানীয় প্রতিনিধিকে বলেন, অতীতেও এমন অভিযান হয়েছে কিন্তু ক্লিনিক বন্ধ হয় না, সাময়িক কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। আবার চালু হয়ে যায়। তবে বেড়ে যায় ঘুষের পরিমাণ।
স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. বিল্লাল হোসেন বলেন, কেউ আবেদনপত্র জমা দিয়ে ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলতে পারবে না। আগে অনুমোদন নিতে হবে। স্হানীয় প্রশাসন যেখানে অনুমোদনহীন ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পাবে সেটা বন্ধ করে দেবে। আমাদের অভিযান কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা নিতে বিভাগীয় পরিচালক ও জেলা সিভিল সার্জনদের বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বুধবার স্বাস্হ্য অধিদপ্তরে বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো
৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করতে হবে। অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। এ কার্যক্রমে স্হানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্হার সঙ্গে সমন্বয় করতে যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়ে নবায়ন করেনি, তাদের নবায়নের জন্য একটি সময়সীমা দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নবায়ন না করলে সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে অস্ত্রোপচারের সময় অ্যানেস্হেসিয়া দেওয়া এবং ওটি অ্যাসিস্ট করার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত ডাক্তার ছাড়া অন্যদের রাখা হলে সেসব প্রতিষ্ঠান ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্হা নেওয়া। যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন নিবন্ধনের আবেদন করেছে, তাদের লাইসেন্স দেওয়ার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে। লাইসেন্স প্রাপ্তির আগে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাতে পারবে না।
সাভারে অনিবন্ধিত দুটি হাসপাতাল সিলগালা
এদিকে সাভারের দুটি অনিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়েছে সাভার উপজেলা স্বাস্হ্য প্রশাসন। স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের নির্দেশের পর গতকাল বৃহস্পতিবার সাভার থানা রোডে অবস্হিত মুক্তি ক্লিনিক ও বাসস্ট্যান্ড এলাকার সাভার জেনারেল হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটিকে সিলগালা করে দেওয়া হয়। উপজেলা স্বাস্হ্য কর্মকর্তা ডা. সায়েমুল হুদার নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমাণ দল সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ অভিযান চালায়। উপজেলা স্বাস্হ্য কর্মকর্তা ডা. সায়েমুল হুদা বলেন, অভিযানকালে মুক্তি ক্লিনিক ও সাভার জেনারেল হাসপাতাল কতৃর্পক্ষ তাদের অনুমোদনের কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠান দুটিকে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
টাঙ্গাইলে ভুল চিকিত্সায় মা-নবজাতকের মৃত্যু, তদন্ত কমিটি
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে অনুমোদনহীন অবৈধ বেসরকারি একটি ক্লিনিকে সরকারি চিকিত্সকের ভুল চিকিত্সায় প্রসূতি মা-সহ নবজাতকের মৃতু্যর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা স্বাস্হ্য বিভাগ। ঐ কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে টাঙ্গাইল জেলা সিভিল সার্জন ডা. ফজল আবুল মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন খান এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
বুধবার রাতে ভূঞাপুর উপজেলা পৌর শহরের কাঁচা বাজারে অবৈধ মা ক্লিনিক অ্যান্ড হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার (ওটিতে) ডাক্তারের ভুল চিকিত্সায় লাইলী বেগমসহ (৩০) নবজাতক মারা যায় বলে দাবি করেছে স্বজনরা। এ ঘটনার পর তাত্ক্ষণিক ক্লিনিকের মালিক, কর্মরত চিকিত্সক ও নার্সরা মরদেহ রেখে পালিয়ে যান। লাইলী উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের খানুরবাড়ী গ্রামের আতোয়ার হোসেনের স্ত্রী।
আরো পড়ুন : পদ্মা সেতুর চাপ নিতে প্রস্তুত নয় রাজধানী