‘আম্মা মারা গেছেন, কিন্তু আম্মাকে কোথায় দাফন করবে? নানাবাড়িতে কোনো উঁচু জায়গা নেই, আমাদের নিজেদের বাড়ি তো আগেই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে রইব্বার ভিটা নামে পরিচিত টিলার মতো জায়গা তখনো ডুবে নাই। ভিটার মালিকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সেখানেই আম্মাকে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। এক হাত মাটি খোঁড়ার পরই পানি উঠে যায়। শেষমেশ বিশেষ কায়দা করে নিচে এবং চারপাশে কলাগাছ দিয়ে কোনোমতে পানি আটকে আম্মাকে কবর দেওয়া হয়। সে এক বিভীষিকাময় অবস্থা।’
এ বিবরণ দিয়েছেন ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় মা হারানো ওমর ফারুক। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও গ্রামের ছেলে ওমর ফারুকের বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। তবে স্মৃতিগুলো ঝাপসা হলেও সেদিনের কথা এখনো ভুলতে পারেননি তিনি।
গান লেখার পাশাপাশি গণমাধ্যমে কাজ করা ওমর ফারুকের বয়স এখন ৩৯ বছর।
এবার ভয়াবহ বন্যা শুরু হয়েছে সিলেটে। বন্যা যতই বাড়ছে, ওমর ফারুকের মনের উদ্বেগ ততই বাড়ছে। সিলেটের এ বন্যায়ও তো কেউ মা বা অন্য কোনো স্বজন হারাবেন। আর বন্যায় কেউ মারা গেলে দাফন, সৎকার কোথায় হবে?
ওমর ফারুক ১৭ জুন বন্যায় মাকে কবর দেওয়া নিয়ে ফেসবুকে একটি লেখা পোস্ট করেছেন। মুঠোফোনে বললেন, ‘বন্যার পানি একদিন থাকবে না।
নেমে যাবে। আবার স্বাভাবিক হবে জনজীবন। কিন্তু বন্যার বিভীষিকাময় প্রতিটি মুহূর্ত আমার মতো অনেককেই তাড়া করে বেড়াবে সারাটা জীবন। বুকের মধ্যে এমন এক ছোবল দিয়ে যাবে এই বন্যা, যার বিষের যন্ত্রণা তাকে আজীবন ব্যথা দিয়ে যাবে। সে কখনোই এই বিভীষিকার কথা ভুলে থাকতে পারবে না।’
রাজধানীর নিকেতনে থাকেন ওমর ফারুক। তাঁর মায়ের নাম তাসলিমা বেগম। বাবা এম এ জলিল মারা গেছেন ২০১০ সালে। ওমর ফারুক জানালেন, বাবা মারা যাওয়ায় স্নাতক পাসের পর পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবা ওমর ফারুকের ছোট খালাকে বিয়ে করেন। ওমর ফারুকেরা এখন চার ভাইবোন। ছোট খালা নাজমা বেগমই তাঁদের সবার মা। তিনিই সবাইকে আগলে রেখেছেন।
আলাপে ওমর ফারুক আবার চলে গেলেন ১৯৮৮ সালে। বললেন, মা মারা যাওয়ার পর মাকে একটি চৌকির ওপর শুইয়ে রাখা হয়। চারদিকে থই থই পানি। পাশের বাড়ি থেকেও মাকে দেখার জন্য লোকজনকে সাঁতরে আসতে হয়েছিল। মা মারা গিয়েছিলেন নানাবাড়ি পাপরাইল গ্রামে। দাদাবাড়ি থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। মা মারা যাওয়ার পর নৌকায় করে মায়ের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দাদাবাড়ির কাছে রইব্বার ভিটা নামক টিলাটিতে।
ওমর ফারুক বললেন, ‘মায়ের কবরের মাটি খোঁড়ার পর ওলা, পিঁপড়ায় পুরো এলাকা ছেয়ে যায়। মানুষজনের দাঁড়ানোই কষ্টকর ছিল। মেজ মামা আমাকে কোলে নিয়ে শেষবারের মতো আম্মার মুখ দেখালেন। বেশিক্ষণ দেখতে পারলাম না। আকাশে মেঘ, যেকোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। কোনোমতে আম্মাকে দাফন করে রেখে আসতে হয়েছিল।’
ওই বন্যায় দুই দিনের জ্বরে শুধু মা মারা গেছেন তা–ই নয়, মা মারা যাওয়ার এক মাসের মাথায় পাঁচ মাস বয়সী ছোট ভাইটাও মারা যায় বলে জানালেন ওমর ফারুক। আর মা মারা যাওয়ার সময় আরেক ছোট ভাই সুমনের মায়ের মৃত্যুর বিষয়টি বোঝার বয়সই হয়নি। ওমর ফারুক বললেন, তাঁর নিজের যে বয়স ছিল, সে বয়সেও খুব যে বেশি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন, তা–ও নয়। তারপরও চোখের সামনে স্মৃতিগুলো এখনো স্পষ্ট।
১৯৮৮ সালের বন্যায় ঘরে হাঁটুপানি ছিল। চৌকির একেকটা পায়ার নিচে পাঁচটি করে ইট দিয়ে উঁচু করেও হয়তো শেষ রক্ষা হবে না। তাই বাবা ওমর ফারুকদের নানাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই বাড়িতে পানি থাকলেও খানিকটা উঁচু জায়গায় ছিল। ওমর ফারুকের বড় চাচার নৌকা ছিল, তাতে করেই সবাই নানাবাড়ি গিয়েছিলেন। তবে নানাবাড়ি যাওয়ার দিন সন্ধ্যা থেকেই ওমর ফারুকের মায়ের জ্বর শুরু হয়। একদিকে পানি থেকে সবাইকে রক্ষা করা, আরেক দিকে মায়ের জ্বর কমছে না। বুড়ির হাটের ‘গফুর ডাক্তার’ই ছিলেন একমাত্র ভরসার জায়গা। তাঁকে বাড়িতে আনা হয়েছিল, ইনজেকশন দেওয়ার পর জ্বর কমেছিল। তবে মা জানিয়েছিলেন, তাঁর ভালো লাগছে না। ওমর ফারুক আজও জানেন না, মা আসলে কোন রোগে মারা গিয়েছিলেন।
ওমর ফারুক জানালেন, মা মারা যাওয়ার পর প্রায় ১০ বছর পর ওই টিলার মালিক ওই জায়গায় কাজ করবেন বলে মায়ের কবর সেখান থেকে সরাতে বলেন। এত বছর পর আবার মায়ের কবর খুঁড়তে হয়েছিল। কিছু হাড় পাওয়া গিয়েছিল। দেহাবশেষ এনে আবার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সুত্র- প্রথম আলো