প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বহিরাগত শক্তির যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীকে গড়ে তোলা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। আমরা বঙ্গবন্ধুর ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু বহিঃশক্তির যে কোনো আক্রমণ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যাপ্ত সক্ষম করে তুলতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।”
আজ বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’-এর ‘দশম টাইগার্স পুনর্মিলনী’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের দেশকে একটি শান্তিপূর্ণ দেশে রূপান্তরিত করতে চাই। তাই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী সব সময় দেশ ও জণগণের পাশে আছে। যে কোনো দুর্যোগে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী তাদের পাশে দাঁড়ায়; শুধু দেশে নয়, বিদেশেও।
শেখ হাসিনা বলেন, যখনই বন্ধুপ্রতিম কোনো দেশে দুর্ঘটনা ঘটে, তখনই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সেখানে যায় এবং উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ ও সেবা দিয়ে থাকে। পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, শান্তিরক্ষী বাহিনী গৌরবজনকভাবে দায়িত্ব পালন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে যাচ্ছে।
তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাম্প্রতিক তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধারকাজে সফলভাবে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তার হৃদয়ের খুব কাছের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শহীদ তার দুই ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এ রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে যোগ দেওয়া একদিকে আমার জন্য বেদনাদায়ক, অন্যদিকে আনন্দের।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে রেজিমেন্টের একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। প্রধানমন্ত্রী সালাম গ্রহণ করেন এবং খোলা জিপে চড়ে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। এ সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ তার সঙ্গে ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও প্রত্যক্ষ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা এ দেশকে গড়ে তুলেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময়ই তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন এবং সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নেন।
সরকারপ্রধান বলেন, ১৯৭৪ সালেই জাতির পিতা কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির উদ্বোধন করেন এবং কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল ও সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। তিনি ভারত ও যুগোস্লাভিয়া থেকে নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ করেন। ১৯৭৩ সালে সে সময়ের অত্যাধুনিক সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান, এয়ার ডিফেন্স রাডার বিমানবাহিনীতে যুক্ত করেন। তিনি ১৯৭৪ সালেই একটি প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালে আমাদের বিজয়ের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়। জাতির পিতাকে হত্যার পর সমস্ত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেমে যায় এবং আমাদের স্বাধীনতার আদর্শ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।
শেখ হাসিনা জানান, তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হলে ছয় বছর প্রবাস জীবন কাটাতে বাধ্য হওয়ার পর ১৯৮১ সালে একরকম জোর করেই দেশে ফিরে আসেন। এমন একটি দেশে ফেরেন, যে দেশে তার পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না। খুনিদের ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের হাত থেকে মুক্ত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ’৭১-এর পরাজিত শক্তি এবং ’৭৫-এর ঘাতকরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ’৭৫-এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার সময় তিনি ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই দীর্ঘ সময় আর দেশে ফিরতে পারেননি তারা।
তিনি বলেন, জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ, যে ভাষণ আড়াই হাজার বছরে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্যে ঠাঁই পেয়েছে, সে ভাষণ এবং জয় বাংলা স্লোগানও এ দেশে নিষিদ্ধ ছিল। ’৯৬ সালে একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মানুষ আবার সেই সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ পায়। পাশাপাশি তার সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে সুপ্রশিক্ষিত এবং শক্তিশালী ও আধুনিকায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
প্রথম মেয়াদে সরকারে থাকার সময় তারা ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম মহিলা সৈনিক ভর্তির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছি। আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন এবং ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। অ্যারোস্পেস ও অ্যাভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সিএমএইচগুলোকে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তর করেছি।
প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে তার সরকার সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। গত চার বছরে বিভিন্ন ফরমেশনের অধীনে তিনটি ব্রিগেড এবং ছোট-বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি মাওয়া-জাজিরাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস এবং মিঠামইন, রাজবাড়ী ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলমান। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আর্মি অ্যাভিয়েশনের ফরোয়ার্ড বেস এবং লালমনিরহাটে অ্যাভিয়েশন স্কুল নির্মাণের কাজও প্রক্রিয়াধীন। পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা-কমান্ডো ব্রিগেড যুক্তকরণ এবং প্রতিটি বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সৌম্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা’—এ মূলমন্ত্রে দীক্ষিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময় এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের এই রেজিমেন্টের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। সে জন্য সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি তার গৃহহীন, ভূমিহীনকে ঘর করে দেওয়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন এবং দেশের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণেরও প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতি দেশ ও জাতির আস্থার স্বীকৃতিস্বরূপ এ পর্যন্ত ৩৫টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জাতীয় পতাকা অর্জন করেছে। ২০১৪ সালে আমার হাতে এ প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনটি রেজিমেন্টের জাতীয় পতাকা গ্রহণের স্মৃতি আজ মনে পড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও ধন্যবাদ জানান। তাদের সময়ে তারাও এই বাহিনীকে উন্নত করতে যথাযথ পরিশ্রম করেছেন। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আপনাদের সেই অভিজ্ঞতা আজকের প্রজন্ম স্মরণ করবে এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আনন্দ ও উৎসবমুখর পুনর্মিলনী, অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত সর্বস্তরের সদস্যদের মাঝে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় করবে—এই প্রত্যাশা করছি। আমাদের দেশপ্রেমিক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ অর্পিত সব দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালনে সক্ষম হবে এবং কর্মজীবনে সব ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
তিনি আজকের অনুষ্ঠান সফলভাবে আয়োজন করায় সেনাবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
করোনা মহামারি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব মন্দা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য সবাইকে কৃচ্ছ্রসাধন এবং প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় এনে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোয় দেশবাসীর প্রতি তার আহ্বানেরও পুনরুল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এটা তত দিন অব্যাহত রাখতে হবে, যত দিন না এ যুদ্ধ থামে এবং এ মন্দার কবল থেকে বিশ্ব মুক্তি পায়। সরকার দারিদ্র্যের হার ৪০ ভাগ থেকে ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছে, জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে; কিন্তু এ জন্য সবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
আরো পড়ুন : ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় আমেরিকা