পরিবারের অভাবঅনটন দূর করতে অর্থোপার্জনের জন্য কম মজুরিতে ইটভাটা ও কারখানাসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দিনরাত কাজ করছে শিশুরা। স্কুলের গন্ডি না পেরিয়ে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিনদিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় ইটভাটাসহ কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার শিশু শ্রমিক কাজ করছে। উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটা ঘুরে শিশু শ্রমিকদের এমন চিত্রই দেখা গেছে। উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির বেশ কয়েক জন নেতা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, শ্রম আইনে ইটভাটা ও কলকারখানাসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিক খাটানো নিষিদ্ধ। কিন্তু পরিবারের অভাবঅনটন দূর করার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ইটভাটা শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের শিশু সন্তান কাজ করে কিছু অর্থোপার্জন করে থাকে। মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের কাজ এবং মজুরি দেওয়া হয়।
উপজেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস সূত্র জানায়, পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়নে ১১২ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ ইটভাটায় শিশুরা শ্রমিকের কাজ করে থাকে। পৌরসভা, মহেড়া, জামুর্কি, গোড়াই, লতিফপুর, তরফপুর, আজগানা ও বাঁশতৈল ইউনিয়নেই রয়েছে অধিকাংশ ইটভাটা। এসব ইটভাটায় কাজ করছে উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ, রংপুর, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, নাটোর, কুষ্টিয়া, জামালপুর, শেরপুরসহ বিভিন্ন জেলার শ্রমিকরা। বাবা-মায়ের সঙ্গে ইটভাটায় কাজ করছে শিশুরা। যাদের বেশির ভাগ বয়স ৮-১১ বছর। দিনরাত কাজ করে এসব শিশু প্রতিদিন মজুরি পায় ৫০-৬০ টাকা।
ইটভাটায় কাজ করতে আসা শিশু সামিনুর (৯), মোছা. (১০) ও সাইম (৯)। তিন জনের গ্রামের কুড়িগ্রাম। তারা নিজ এলাকায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করছে। পরিবারের অভাবঅনটন মোছন করতে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে মির্জাপুরে এসেছে ইটভাটায় কাজের সন্ধানে। বাবা-মা দিনরাত কাজ করে পান ৩০০-৪০০ টাকা। সামিনুর, মোছা ও সাইম মজুরি পায় ৫০-৬০ টাকা। হারভাঙা পরিশ্রম করার পরও তাদের মুখে দেখা গেছে ক্লান্তি ও হতাশার ছাপ। আবার এক ঝিলিক হাসিও দেখা গেছে। তিন বন্ধু জানায়, পড়াশোনার অনেক ইচ্ছে ছিল। বাবা-মায়ের অভাবের সংসার। তারা আমাদের সঙ্গে নিয়ে ইটভাটায় কাজের সন্ধানে এসেছে। কী আর করব। এখন আমরা কম মজুরিতে ইটভাটায় কাজ করি। একই অবস্থা দেখা গেছে উপজেলার বাইমহাটি, দেওহাটা, সোহাগপুর, ধেরুয়া, সৈয়দুপর, কোদালিয়া, হাটুভাঙ্গা, আজগানা, বাঁশতৈল, তরফপুরসহ বিভিন্ন ইটভাটায়।
এ ব্যাপারে কথা হয় রংপুর থেকে ইটভাটায় কাজ করতে আসা মোমিন মিয়া (৫৬) ও তার স্ত্রী সালমা বেগম (৪৫) জানায়, অভাবের সংসার। কী আর করব। দুটি ছেলেকে নিয়ে ইটভাটায় কাজ করি। দুই ছেলে দিনে ১২০ টাকা পায় আর আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে পাই ৬০০-৮০০ টাকা। নিজেরা খেয়েদেয়ে কিছু টাকা বাড়ি পাঠাই। বেসরকারি মানবাধিকার উন্নয়ন সংস্থা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেলার প্রধান সমন্বয়কারী মি. গৌতম চন্দ বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আইএলওর নীতি অনুযায়ী শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলেই শিশুদের দিয়ে কাজ করাতে পারেন না। সচেতনমহল লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেসরকারি সংস্থা উদয় এনজিওর নির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দে সুধীর চন্দ বলেন, পরিবারের অসচেতনতার কারণে ২-৩ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে তাদের ভবিষ্যত্ জীবন যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, তেমনি দেশে বাড়ছে বেকার সমস্যা। শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি সরকারিভাবে অভিভাবকদের সচেতনামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং এসব অসহায় শিশুদের উদ্ধার করে তাদের পড়াশোনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন, যেসব শিশু বিভিন্ন ইটভাটাসহ বিভিন্ন কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছে তাদের তালিকা সংগ্রহ করে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের বোর্ড সভার মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে। এজন্য উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. হাফিজুর রহমান বলেন, পরিবারের দরিদ্রতা ও বাবা-মায়ের অসচেতনতার কারণেই অনেক পরিবারের শিশুরা ইটভাটাসহ বিভিন্ন কারখানা ও দোকানপাটে ভারী কাজ করে থাকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করে এসব শিশুদের সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আরো পড়ুন : এভেরোজ স্কুল সম্মাননা দিল ১০৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে