সাম্প্রতিক আন্দোলনে যুবদল, ছাত্রদলসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ভূমিকায় খুবই ত্যক্ত-বিরক্ত বিএনপি। দলটির আন্দোলন পরবর্তী মূল্যায়নে দেখা গেছে, এসব সংগঠনের অধিকাংশ নেতাই লোক দেখানো ভূমিকা রেখেছেন মাঠে। কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি তারা। মাঝারি ও তৃণমূল পর্যায়ের কিছু নেতা মাঠে নামতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন। অথচ যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ-যুবসমাজই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে দলটির চলমান ‘সরকার পতন’ আন্দোলনে যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জাসাস, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, ওলামা দলসহ কোনো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনই উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। উপরন্তু অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে বিপদ দূর করে নির্বাচনের পর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন। জানা গেছে, তাদের এই গা-বাঁচানোর ‘নামকা ওয়াস্ত’ ভূমিকায় বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহলসহ মূল দলের নেতা-কর্মীরা চরম বিরক্ত।
এ অবস্থায় পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং নেতা-কর্মীদের আবারো সক্রিয় করতে সংগঠনগুলোকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির গঠন ও পুনর্গঠন ছাড়াও মেয়াদ থাকাবস্থাতেই গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শীর্ষ নেতা তারেক রহমান এ ব্যাপারে পরিষ্কার ও কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে- কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি নগর-মহানগর কমিটিতেও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) জাতীয়তাবাদী ওলামা দল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি এখন থেকে আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘সুপার ফাইভ’ বা ‘সুপার সেভেন’ নামে ঘোষণা করা হবে না। যথাযথ কাউন্সিলের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচন করা হবে। জানা গেছে, বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু করেছে বিএনপি। পর্যায়ক্রমে সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে নতুন ধাঁচে আনতে চাইছে দলটি। নতুন কমিটি গঠন ও পুরনো কমিটির হালনাগাদ করতে চান দলটির হাইকমান্ড তারেক রহমান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সর্বস্তরে দল পুনর্গঠন ও অঙ্গ-সংগঠনগুলোর নতুন নেতৃত্ব তৈরির দাবি জোরালো হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
এ ছাড়াও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), সম্মিলিত পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের কমিটিতেও পরিবর্তন আনা হতে পারে। শিগগিরই জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের নেতৃত্বেও পরিবর্তন আনা হতে পারে। একইভাবে কৃষিবিদ এবং প্রকৌশলীদের সংগঠনেরও নতুন কমিটি করার কথা। পর্যায়ক্রমে স্বল্প সময়ের মধ্যেই অন্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোরও নতুন কমিটি গঠন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, মেয়াদোত্তীর্ণের কাছাকাছি চলে গেছে বিএনপির সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কমিটি। পদ-পদবি নিয়ে নেতা-কর্মীদের মাঝে গ্রুপিংসহ বিভিন্ন কারণে সংগঠনটি এখন কঠিন সংকটে। বিএনপির যে কয়েকটি সহযোগী সংগঠন রয়েছে তার অন্যতম কৃষক দল। এ অবস্থায় তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতা নির্বাচন করা হতে পারে।
জানা গেছে, ছাত্রদলের কমিটির মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দায়িত্বে অবহেলার কারণে মাস কয়েক আগে রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খানকে। এখনো পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে চলছে সংগঠনটি। জাতীয়তাবাদী যুবদলের কমিটির মেয়াদ শেষ না হলেও এই সংগঠনের শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় বেশির ভাগ নেতাই আন্দোলনের পুরোটা সময় ছিলেন গা ঢাকা দিয়ে। সারা দেশে তৃণমূল ও মাঝারি পর্যায়ের নেতারা গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকার হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বেচ্ছাসেবক দলেরও একই অবস্থা। শ্রমিক দল, তাঁতী দল ও মৎস্যজীবী দলের আরও বেহাল অবস্থা। ত্যাগী নেতাদের প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠনের দাবি অনেক আগে থেকেই করে আসছেন নেতা-কর্মীরা।
কেন্দ্রীয় বিএনপির এক নেতা বলেন, আগে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি করা হতো যাকে অনেকেই ‘পকেট কমিটি’ বলত। এতে করে তৃণমূলের মতামত উপেক্ষিত হয়। এবার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে তৃণমূলের মতামতও থাকবে। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সব কমিটির নেতা নির্বাচন করা হবে। তবে সাম্প্রতিক সরকার পতন আন্দোলনে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন লাপাত্তা। তৃণমূলসহ মাঝারি পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা হামলা-মামলা, নির্যাতন ও গ্রেফতার কারাদণ্ডের শিকার হলেও তাদের (কেন্দ্রীয়) বেশির ভাগই ছিলেন আত্মগোপনে। তাছাড়া মূল দলসহ এসব অঙ্গ সংগঠনের মহানগর কমিটিতেও ব্যাপক পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ওলামা দলের নতুন কমিটি : জাতীয়তাবাদী ওলামা দল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন দুটি আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। গতকাল দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক অধ্যক্ষ শাহ মোহা. নেছারুল হক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক হিসেবে হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও মুফতি রিয়াজুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে ২১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করা হয়। অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক হিসেবে মাওলানা আলমগীর হোসেন খলিলী ও মাওলানা তাজুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে ১১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে।
আরো পড়ুন : ১৭০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিল ২০ প্রতিষ্ঠান