**চিকিৎসায় অতিরিক্ত ফি আদায় করছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক **সক্ষমতার বাইরে গেলে অব্যবস্থাপনা হবে, তাই সময় থাকতে মশা নিধন করুন: ডা এ বি এম
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিনে দিনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এরই মধ্যে মৃত্যুর দিক থেকে ছাপিয়ে গেছে বিশ্বের সকল দেশকে। চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৪৫। অন্যদিকে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা পেরুতে মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪৩। ১৫ লাখ ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ আক্রান্তের দেশের অবস্থান দখল করা ব্রাজিলে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ২৫। দেশে গত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর এডিস মশাবাহিত রোগটিতে ১০০ জনের মৃত্যু হল। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ১৬২৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর এই সংখ্যাও একদিনে সর্বাধিক।
এদিকে সরকারি হাসপাতালে আর কোন সিট খালি নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ও মিটফোর্ট হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। মেঝেতে, করিডোরে রেখে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, একটি মাত্র শয্যার আশায় হাসপাতাল ছাড়ার আগেই সিটের পাশে অন্য রোগীর অপেক্ষা। বেসরকারি হাসপাতালেও অনেক রোগীর চাপ। হলি-ফ্যামিলি হাসপাতাল রোগী ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় অতিরিক্ত ফি আদায় করছে এক শ্রেণীর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এবার বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। সরকার ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত এই ফি এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে ইচ্ছামতো ফি আদায় করা হচ্ছে। ওষুধের দামও বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এই নৈরাজ্য যেন দেখার যেন কেউ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগ শুধু আদেশ দিয়ে বসে থাকে। কোন ধরনের মনিটরিং করা হয় না। সিভিল সার্জন অফিস থেকে শুরু করে, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা দুর্নীতি, অনিয়ম ও কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। তাদের মধ্যে শুধু খাইখাই ভাব।
রাজধানীর ঘরে ঘরে জ্বর। ডেঙ্গুর পাশাপাশি ভাইরাল ফিভার আছে। এই দুই জ্বরের উপসর্গও একই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, ডেঙ্গু রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে অন্যান্য জরুরি রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও যা জনবল আছে, তাই দিয়ে সর্বাত্মকভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। বেসরকারি এক শ্রেণীর হাসপাতাল এই ধরনের মহামারী শুরু হলে মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায় করার কাজে ব্যস্ত থাকে। তবে বাণিজ্যিক নয়, মানবিক মনোভাব থাকা উচিত বলে হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। এক শ্রেণীর বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো ইচ্ছামতো ফি আদায় করছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা বলছেন, আমরা মালিকদের কাছে অসহায়। আর মালিকরা বলেন, আমরা অসহায় ডাক্তারদের কাছে। অর্ধেক টাকা নিয়ে যান ডাক্তাররা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে অর্ধেক কমিশনও ডাক্তাররা নিয়ে যান।
ডাক্তার-নার্সরা আক্ষেপ করে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আমরা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু জীবনবাজি রেখে রোগীদের শতভাগ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করি। এক্ষেত্রে আমরা পিছপা হই না। তারা বলেন, করোনার সময়ও যেমন রোগীদের পাশে থেকে বিরতিহীনভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতির সময়ও আমরা অনুরূপভাবে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। অনেকটা আক্ষেপ করে ডাক্তার-নার্সরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য সেবা ও নার্সিং খাতের উন্নয়নে দুই হাত ভরে উনি দিয়েছেন। তার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা বাস্তাবয়নে যাদের দায়িত্ব স্বাস্থ্যখাতের দেখভাল করার, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। চিকিৎসক ও নার্সদের পদোন্নতি পেতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নার্সদের সিলেকশন গ্রেড দেওয়া হয় না। দীর্ঘদিন ধরে এটি আটকে রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সিলেকশন গ্রেড না পেয়ে অনেকে আক্ষেপ নিয়ে অবসর নিয়েছেন। নার্সিংক কলেজগুলোতে অধ্যক্ষ, ভাইস প্রিন্সিপাল, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের উচ্চতর ডিগ্রিধারী অভিজ্ঞ জনবলও রয়েছে। কিন্তু তাদেরকে সেখানে স্থায়ীভাবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের নিজ বেতনে অথবা চলতি দায়িত্বে পদায়ন দিয়ে নার্সিং কলেজগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ নার্সদের অনেকটা হাত-পা বেধে বলে দিচ্ছে সাঁতার কাটতে। নার্সিং অধিদপ্তরের অধিকাংশ কর্মকর্তা হলেন নন-মেডিক্যাল পার্সন। তাদের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতিসহ অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাকে কোথায় দিবেন, সেই বিষয়েও তাদের ধারণা নেই। উল্টো বসে বসে মোড়লিপনা করেন- এমন আক্ষেপ জানান সেখানকার কতিপয় কর্মকর্তারা। এই অধিদপ্তরে এসে অনেক নার্সরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন পদে পদে। ডাক্তাররা বলেন, আমরা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। করোনার সময় অনেক চিকিৎসক মারা গেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু কেউ চিকিৎসা সেবা দেওয়া থেকে পিছপা হননি। এখনো অনেক চিকিৎসক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তারপরও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। যখন মহামারী হয়, তখন ডাক্তারদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরপর আর আমাদের গুরুত্ব থাকে না। আমরা চরম বৈষম্যের শিকার। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে মোড়লিপনা দেখিয়ে লাভ নেই। সরকারি হাসপাতালে চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক মেশিন নষ্ট পড়ে আছে। মেরামত করা হয় না। রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন এক শ্রেণীর কর্মকর্তা। কারণ এতে বাড়তি অর্থ পাওয়া যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সক্ষমতার বাইরে গেলে অব্যবস্থাপনা হবে-এটাই স্বাভাবিক। যেটা আমরা করোনার সময় দেখেছি। এখনো সময় আছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে হলে মশা নিধন করতে হবে। রাতারাতি হাসপাতাল ও আইসিইউ বানানো যাবে না। তাই মশা মারার কোন বিকল্প নেই।
আরো পড়ুন : আজ শেখ হাসিনার কারাবন্দি দিবস