নিজস্ব প্রতিবেদক : দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক ট্রানজিট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এক দশকে তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন অন্তর্বর্তী সরকার বহুমুখী ট্রানজিটের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি ঢাকায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেছেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের কেন্দ্র হতে চায়। এ ক্ষেত্রে ভারত, নেপাল, ভুটান ছাড়াও পূর্বের মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ছাড়িয়ে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্ক তৈরির লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ট্রানজিট সম্পর্ক স্থাপন। এ নিয়ে অনেক কমিটি, অনেক সেমিনার, অনেক আলোচনা হয়েছে। বছরের পর বছর ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত ফল মেলেনি। লক্ষ্য অনুযায়ী একটি বহুমুখী উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। তার বদলে যেটি হয়েছিল, বিশেষজ্ঞদের মতে সেটা আসলে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে এক অংশ থেকে অন্য অংশে (সেভেন সিস্টার্সে) পণ্য পরিবহন সুবিধা পেয়েছে ভারত। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা হলেও এই দেশগুলোর সঙ্গে উভয়মুখী কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ট্রানজিট বলতে আমরা বুঝি সিমলেস কানেকটিভিটি; অর্থাৎ একটি অঞ্চল বা উপ-অঞ্চলের মধ্যে সড়ক, নৌপথ, আকাশপথ এবং রেলপথে বহুমুখী ও কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা; বিগত সময়ে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা বলা যেতে পারে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ চাইছিল দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বহুমুখী উপ-আঞ্চলিক বহুমুখী কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে। যেহেতু নেপাল ও ভুটান দুটি দেশই ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্র, সে কারণে ওই দুটি দেশের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধা চালুর ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তবে সমস্যা ছিল নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশে ট্রানজিট সুবিধা নিতে হলে ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করতে হয়। সংশ্লিষ্ট দেশ দুটি ওই সুবিধা পেয়ে আসলেও ভারতের করিডোর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি বাংলাদেশের। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে নিয়ে যে কানেকটিভিটি গড়ে তুলতে চেয়েছিল বাংলাদেশ, সেটি কার্যকর হয়নি।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে চারদেশীয় মোটরযান চলাচল চুক্তি কার্যকর হলে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ নিয়ে বাংলাদেশের যে প্রত্যাশা ছিল সেটি পূরণ হতো। ভারতের নেতৃত্বে ২০১৫ সালে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে চারদেশীয় মোটর ভেহিক্যাল (বিবিআইএন) চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। প্রথমে ভুটান সরে যায়, পরে নেপালও আগ্রহ দেখায়নি। ফলে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ সম্পর্ক সেখানেই পথ হারায়।
সূত্র জানায়, ভারতকে বাংলাদেশ মূলত মাল্টিমোডাল বা বহুমাত্রিক ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় ২০১০ সাল থেকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, তার একটি ‘ক্লজ’ আমলে নিয়ে এই ট্রানজিট সুবিধা কার্যকরের কার্যক্রম চলে। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তির ধারা ৫ অনুযায়ী ভারতের মধ্যে ৫ বছর মেয়াদি অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল (পিআইডাব্লিউটিটি) স্বাক্ষরিত হয়। তারপর থেকে এ চুক্তি নিয়মিতভাবে নবায়ন হয়ে আসছে। এ প্রটোকলের আওতায় নৌপথে ট্রানজিট সুবিধা পায় দেশটি। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি রাজ্যে নিয়মিত পণ্য পরিবহনে বহুমুখী ট্রানজিট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। ২০১৬ সালের জুন থেকে ভারতকে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকলের আওতায় প্রথমে কলকাতা-আশুগঞ্জ নৌপথ এবং তারপর আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কপথ ব্যবহার করে ত্রিপুরার আগরতলায় পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’ চুক্তি হয়। পরবর্তীতে, ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয় দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের রূপরেখা বিষয়ে এসওপি সই হয়। ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে স্থায়ী আদেশ জারি করে এনবিআর। নৌপথের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দুই দেশের সীমান্তে বন্ধ হয়ে যাওয়া রেল সংযোগগুলো চালু করা হয়। সংস্কার করা হয় রেললাইন ও স্টেশন। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। আর ক্ষমতা-পতনের কয়েকদিন আগে গত জুনে ভারত সফরে গিয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ভারতকে রেল ট্রানজিট দেওয়ার সমঝোতা চুক্তি করে আসেন শেখ হাসিনা। যেই চুক্তির আওতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গেদে-দর্শনা থেকে পণ্যবাহী রেল বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ভূখন্ড ব্যবহার করে আবার হলদিবাড়ী-চিলাহাটি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তিস্তা চুক্তি না করে, তিস্তার পাড় দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশ থেকে এই রেল ট্রানজিটের ব্যাপক বিরোধিতা করে সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক দলগুলো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে শ্রেফ ‘করিডোর চুক্তি’ উল্লেখ করে এই চুক্তি মেন না নেওয়ার ঘোষণা দেন অনেকেই। তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার এভাবে সব কিছু ভারতের হাতে তুলে দিতে পারে না। আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হব।’