‘আইওএম আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছে

ওকে নিউজ স্পেশাল পুরুষ অধিকার পুরুষ নির্যাতন প্রচ্ছদ প্রবাস হ্যালোআড্ডা

অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে একমাত্র ছেলে ইয়াকুব হাসানকে দালালের মাধ্যমে টুরিস্ট ভিসায় লিবিয়ায় পাঠান শাহিনুর বেগম। ২০১৯ সালের মে মাসে দেশটিতে পাঠান ছেলেকে। সেখানে বেনগাজিতে একটি তেল কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশি টাকায় প্রতিমাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন ইয়াকুব।

ইয়াকুবের বাবা আবুল খায়ের আগে থেকেই লিবিয়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। বাবা আর ছেলে লিবিয়ায় কাজ করে যে টাকা আয় করতেন, সেই টাকা দিয়ে প্রথম দুই বছর সংসার বেশ ভালোই চলছিলো। পরে আরও বেশি টাকা উপার্জনের স্বপ্ন দেখেন ইয়াকুব। সিদ্ধান্ত নেন ইতালি যাবেন।
বেশি টাকা উপার্জনের আশায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ‘মাফিয়াদের’ হাতে বন্দী হন ইয়াকুব। এরপর থেকে সংসারে নেমে আসে বিপর্যয়।

একমাত্র ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিতে বলেছিলেন পরিচিতজনেরা। ‘মাফিয়ারা তাকে মেরে ফেলেছে, তাকে আর জীবিত পাওয়া যাবে না’ মা শাহিনুর বেগমকে এ সবই বলছিলেন প্রতিবেশীরা। এরপরও গত ছয় মাস ধরে ছেলের সন্ধান জানা এবং তার মুক্তির জন্য দালালদের প্রায় ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা দিয়েও কোন কাজ হয়নি। পরে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় লিবিয়ায় যাওয়ার উদ্যোগ নেন মা শাহিনুর। শাহিনুর বেগম দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী আবুল খায়েরের স্ত্রী।

শাহিনুর বেগম বলেন, ‘ছেলের সন্ধান না পেয়ে আমার স্বামী দুই বার স্ট্রোক করেছেন। তারও অবস্থাও খুবই খারাপ হয়ে যায়। দেশে এ খবরে আমার এক একটা দিন মনে হচ্ছিল আমি জাহান্নামের কোন আজাবে পড়ে আছি। পাগলের মতো এদিক-সেদিক ছুটেছি। পাড়া-প্রতিবেশীরাও ছেলেকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে বলেন। পরে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নেই, ছেলেকে যেকোনো মূল্যে উদ্ধার করতেই হবে। আমি নিজেই লিবিয়ায় যাব। মেয়ের জামাইয়ের সহযোগিতায় পাসপোর্ট ও ভিসা করি। পরে টিকেট কিনি। গরু, ছাগল ও জমি-জমা বিক্রির প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। পরে ৯ জানুয়ারি আমার ফ্লাইট হয়। আমি প্রথমে দুবাই যাই, সেখানে ১ দিন থেকে পরের দিন মিশরে যাই। মিশরে ২৪ ঘণ্টা যাত্রা বিরতির পর লিবিয়ার বেনগাজিতে স্বামীর কাছে পৌঁছাই।’

শাহিনুর আরও বলেন, ভাষা জানতাম না, ‘প্রথমে সেখানে বাংলা ভাষা যারা জানেন আমি এমন কয়েকজনকে খুঁজে বের করি। পরে তাদের আমি সব ঘটনা খুলে বলি। তারা আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করিয়ে দেন। পরে আমি দূতাবাস ও আইওএম-এর কর্মকর্তাদের সব খুলে বলি, তারা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন। এরপর আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধারের চেষ্টা চালান। এক পর্যায়ে তারা ফোনে আমার সঙ্গে আমার ছেলের কথা বলিয়ে দেন। ফোনে ছেলের কণ্ঠ শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমার ছেলেও ওপাশ থেকে কান্না করতে থাকে। ছেলেকে দেখার জন্য বুক ফাটা আর্তনাদ হচ্ছিলো আমার। কিন্তু লিবিয়ায় আমাদের দেখা হয়নি। ছেলে তখন ত্রিপলিতে ছিল, আর আমি বেনগাজিতে।’

আইওএম ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় শাহিনুর বেগম গত ৮ মার্চ বেনগাজি থেকে এবং ইয়াকুব ১৬ মার্চ ত্রিপলি থেকে ঢাকায় ফিরেন। লিবিয়া থেকে ফেরার পর ঢাকার আশকোনার হজ ক্যাম্পে তাদের রাখা হয়। পরে ২১ মার্চ মা ও ছেলে নিজ গ্রামের বাড়ি দেবিদ্বারে ফেরেন।

ইয়াকুব হাসান বলেন, জাহাঙ্গীর নামের একজনের পরামর্শে অবৈধভাবে ২০২১ সালের শুরুর দিকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ইতালি যাওয়ার জন্য রফিক নামের এক দালালকে ৪ লাখ টাকা দিই। এরপর প্রথমে গাড়িতে করে বেনগাজি থেকে ত্রিপলিতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে নৌকায় ইতালির ল্যাম্পিদুসা দ্বীপে পৌঁছায়। আমার সঙ্গে নৌকায় ৩০০ জন যাত্রী ছিলেন, তাদের মধ্যে ১৫০ জন বাঙালি। নৌকার মাঝির ওয়ারলেস চালু থাকায় যাত্রার শুরুতেই আমাদের নৌকা লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে। এ দিন সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার মানুষকে আটক করা হয়। যাদের পরিচিত লোকজন ছিল তাদের ঘাট থেকে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমিসহ অন্যদের জেলে পাঠানো হয়।

জেলে তাদের ওপর খুব অত্যাচার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘জেলে আমাদের ওপর খুব অত্যাচার করা হয়েছে। খাওয়ার জন্য একটা রুটি আর পানি দিত। ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্টগার্ডকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে আমি ছাড়া পাই।’

এই ঘটনার প্রায় ৮মাস পর আবারও ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন ইয়াকুব। এবার তার বিপদ আরও বেড়ে যায়। এ সময় ‘মাফিয়ারা’ তাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘মাফিয়ারা আমাদের মোবাইল, টাকা ও কাপড়-চোপড় সবকিছু নিয়ে নেন। তারা আমাদের জিম্মি করেন। ছোট একটি ঘরে আমাদের ৭ দিন রাখা হয়। ঘরটিতে কোনো আলো-বাতাস ছিল না। শুধু অন্ধকার। সপ্তাহে ২-৩ দিন পর পর খাবার দেওয়া হতো। আমাদের প্রতিদিন একবার ঘর থেকে বের করে তারা মারতেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা দিয়েই মারতেন। কিছু দালালের মাধ্যমে তারা সবার পরিবারকে জিম্মি করার বিষয়টি জানায়। সেখান থেকে বের করে আমাদের গরু জবাই করা হয় এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছুদিন রেখে আরেকটি জায়গায় নেওয়া হয়। সেখানে প্রায় ৩০০ জনকে একটি রুমে রাখা হয়। প্রতিদিন এখানে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা যান। দীর্ঘদিন খাবার না পেয়ে অনেকের পেটের সমস্যা হয়েছিল। অনেকের শরীরে ঘা হয়েছিল, শরীর থেকে পুঁজ পড়ছিল। আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা হয়। তারা কোনো চিকিৎসা দিত না।’

বাঙালিদের ওপর অনেক বেশি অত্যাচার করা হয়ে উল্লেখ করে ইয়াকুব বলেন, ‘আমাদের যেখানে রাখা হয় সেখানে ৭ জন বাংলাদেশি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের একজনের নাম সুজন। বাকিদের নাম মনে নেই। তারাও মাফিয়াদের হাতে অনেক আগে ধরা পড়েছিলেন। তবে তারা মাফিয়াদের কিছুটা বিশ্বস্ত। এই ৭ জন আমাদের নিয়মিত মারতেন। কোনো কথা ছাড়াই হাতের কাছে যা পেতেন তা দিয়েই মারতেন। তাদের কোনো মায়া-দয়া ছিল না। তারাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছেন। আমাদের ৩০০ জনের জন্য প্রতিদিন ৩০০টি রুটি দেওয়া হতো। এই ৭ জন ৩০টি রুটি রেখে বাকি ২৭০টি রুটি আমাদের দিতেন। আমরা সেগুলো ভাগ করে খেতাম। আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা একজনকে অনেক অনুরোধ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার ফোনটি নেই। আমি শুধু বাবাকে জায়গার নাম বলি এবং কাউকে আর কোনো টাকা না দেওয়ার জন্য বলি। কারণ সব টাকা দালালরা খেয়ে ফেলেন। বাবার সঙ্গে আমার ১৭ সেকেন্ড কথা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারিতে একদিন একজন এসে আমার ও আমার বাবার নাম বলেন। আমি তখন তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমার ছবি তুলে নেন। সেদিন খুব খুশি হই, কারণ বুঝতে পারছিলাম এবার ছাড়া পাব।’

শাহিনুর বেগম বলেন, ‘ছেলেকে ফিরে পেতে অনেক কেঁদেছি। আর আল্লাহর কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। আল্লাহ আমার মানিককে ফিরিয়ে দিয়েছেন। গরু-ছাগল, জমিজমা বিক্রি করে, বন্ধক রেখে ছেলের মুক্তির জন্য টাকা পাঠিয়েছি। সব টাকা দালালরা খেয়ে ফেলেছেন। ছেলেকে আর কোথাও যেতে দেব না। সরকার যদি আমাদের টাকাগুলো দালালদের কাছ থেকে উদ্ধার করে দেয়, আমাদের খুব উপকার হবে।’

আইওএম-এর কাছে শাহিনুর চিরকৃতজ্ঞ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আইওএম আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছে। তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

অবৈধভাবে টুরিস্ট ভিসায় ছেলেকে পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে শাহিনুর বলেন, ‘অনেক অভাবে ছিলাম। তাই বৈধভাবে পাঠানো সম্ভব ছিল না। কষ্ট থাকলেও অবৈধভাবে সাগর পথে যেন কেউ ইতালি না যায়।’

আরো পড়ুন : দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করা কঠিন

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *