ইমন হোসেন আকাশ। বাইশ বছরের এ যুবক রাজধানীর মিরপুরে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। সংসারের হাল ধরতে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন। অর্থসংকটে মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। আকাশ ও তার মায়ের ছিল ছোট্ট সংসার। গত ৪ঠা আগস্ট রোববার সন্ধ্যায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আকাশ। তার মাথার ডান পাশে গুলি লেগে বাম দিক থেকে বেরিয়ে যায়। শিশু বয়সেই বাবা মতিউর তার মাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। এরপর থেকে আকাশকে নিয়ে শুরু হয় মায়ের সংগ্রামী জীবন। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলেও মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। এখন সন্তানের স্মৃতি বুকে নিয়ে দেখছেন ঘোর অন্ধকার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকাশের মা বেবী আক্তার মানবজমিনকে বলেন, আমার সন্তান বুকে নেই। কতোটা মাস আমার সন্তান আমাকে মা বলে ডাকে না। আকাশকে ছাড়া এখন দিনও ফুরায় না, রাতও যায় না। অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। অনেক যুদ্ধ-সংগ্রাম করে সন্তানটিকে বড় করেছি। আমি অভাবে থাকলেও আমার সন্তানকে কখনো কষ্ট বুঝতে দেইনি। ওর শরীরে কোনো আঘাত লাগলে কখনো আমাকে বলতো না কষ্ট পাবো বলে। আমার সেই আদরের সন্তানটিকে গুলি করে মেরেছে। অনেক সভ্য-শান্ত ছিল ছেলেটি। বাবা ছাড়া যে একটা সন্তান এত ভালো হতে পারে কল্পনার বাইরে। ওর বাবা মতিউর রহমান গার্মেন্টসে চাকরি করতো সেখানেই এক নারীকে বিয়ে করে। এক বছরের একটি শিশুকে নিয়ে কাজ করতে যে আমার এত কষ্ট হতো সেটি একমাত্র আমিই জানি। স্বপ্ন ছিল ছেলেটিকে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ তুলবো। কিন্তু সেই স্বপ্ন গত ৪ঠা আগস্ট শেষ হয়ে যায়।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ওইদিন ওর বন্ধুরা মেসেজ পাঠায় মোবাইলে। এরপর আমি জানতে চাই কোথায় যাবে? আকাশ বলে, আমি আন্দোলনে যাবো। তখন আমি বলি, তুমি আমার একমাত্র ছেলে তোমার কিছু হলে আমার কেউ থাকবে না। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সে ছাত্রদের পানি খাওয়াইতো আবার কখনো আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতো। মিরপুর-১১ নম্বরে আমাদের বাসা। সেদিন প্রথমে ইসিবি চত্বর গিয়ে মিরপুর-১০ নম্বরে যায়। কিছুক্ষণ পরে আমি মোবাইলে কল দিয়ে জানতে চাই কোথায় আছো? সে বলে আমি আসতেছি আম্মু তুমি চিন্তা করিও না। আমি তখন তাকে বলি তুমি খেতে আসো বাসায়। আবার দুপুর কল দিলে ও বলে, আম্মু তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে থাকো আমি বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খেয়েছি। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় আবার কল দিলে সে রিসিভ করে না। পরে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় ওর বন্ধু কল দিয়ে বলে আন্টি আকাশ মারা গেছে। আমি তখন কান্নাকাটি শুরু করেছি। আমার ভাইয়ের কাছে কল দিয়ে বলি আকাশ নাকি মারা গেছে। সে তখন সব জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে আকাশ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওর বন্ধুরা মিরপুর-১০ নম্বরে আজমল হাসপাতালে নিয়ে যায় সেখানে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। পরে আমি হাসপাতালে গিয়ে বাসায় নিয়ে আসি। এরপর শরিয়তপুর আমার বাবার বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আকাশের এক বছর বয়স তখন তার বাবা এক নারীকে বিয়ে করে সেখানে চলে যায়। তখন থেকে ছোট্ট আকাশকে আমি বড় করেছি। ও মাধ্যমিক পাস করেছে এরপর আর পড়াতে পারিনি। পরে সংসারের হাল ধরতে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ শুরু করে। বর্তমানে আমার ডায়াবেটিস, হার্টে সমস্যা, প্রেসার হাই। ঠিকমতো কাজ করতে পারি না মাসে পাঁচ হাজার টাকাই আমার মেডিসিনের পেছনে খরচ হয়। আমি ঘরে রান্না করে লোকজনকে খাওয়াতাম। মাসে বাসা ভাড়া ১৫ হাজার টাকা দেয়া লাগতো। আকাশ মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন পেতো। দু’জনের খাওয়া-দাওয়া করে খুব ভালোভাবে কেটে যেতো। এখন আর আমি ঢাকায় থেকে কি করবো? আকাশ আমার একমাত্র সন্তান ছিল তার মুখের দিকে তাকিয়ে সময় চলে যেতো। এখন আমি সন্তান ছাড়া কীভাবে থাকবো। এতদিন সে ছিল তার ভরসায় আমি এই শহরে ছিলাম। এখন আমি বাবার বাড়িতে চলে যাবো। আমি তো একা হয়ে গিয়েছি। বেশকিছু জায়গায় কাগজপত্র জমা দিয়েছি, কেউ কেউ খোঁজখবর নিয়েছে। আমার সন্তান তো আর ফিরে আসবে না। আমার এতটুকু চাওয়া যে মানুষটি দেশের জন্য জীবন দিয়েছে সে যেন যথাযথ সম্মানটুকু পায়।
আরো পড়ুন : মাথাচাড়া দিচ্ছে মাফিয়া প্রধানের রেখে যাওয়া সুবিধাভোগীরা