ঘটনা গত বছরের এপ্রিলের। রাজশাহী নগরের শাহমখদুম এলাকার ডোবা থেকে একটি ড্রাম উদ্ধার করা হয়। তাতে পাওয়া যায় অজ্ঞাতপরিচয়ের এক তরুণীর লাশ। আঙুলের ছাপের সূত্র ধরে পিবিআই জানতে পারে, তরুণীর নাম ননিকা রানী বর্মণ। পরে তদন্তে জানা যায়, নিমাই চন্দ্র সরকার নামের পুলিশের এক কনস্টেবল তাঁকে হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা করেন।
জামালপুরের মেলান্দহ থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি আরও এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আঙুলের ছাপ মিলিয়ে ১২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর পরিচয় শনাক্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। লাশ শনাক্ত করার পর তরুণীর স্বামী জাহিদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
লাশের পরিচয় শনাক্তে পিবিআই সহায়তা নিচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেইসের (তথ্যভান্ডার)। সেখানে ভোটারদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম।
২০১৯ সালের মার্চে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু করে পিবিআই। তিন বছরে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ৫৯৩টি অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১১৩ জন। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে ১০০টির বেশি।
পিবিআইয়ের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এআইজিপি) বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো লাশের পরিচয় অজ্ঞাত থাকলে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা যায় না। এখন অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ উদ্ধার হলেই পিবিআই তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে। এভাবে অনেক লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়েছে। হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রেও লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
পিবিআই বলছে, অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ শনাক্তের পাশাপাশি আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাই করতে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে সেটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেইসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। মামলার সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা যাচাই করতেও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়। পাশপাশি কোনো অপরাধ হলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক পরিচয় উদ্ঘাটন এবং ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বহনকারীদের শনাক্তে আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়।
আছে সীমাবদ্ধতা: গত তিন বছরে পিবিআই ২ হাজার ৬৭৭টি লাশের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৪ জনের পরিচয়ই জানা সম্ভব হয়নি। আঙুলের ছাপে মাত্র ২২ দশমিক ১৫ শতাংশ লাশের পরিচয় পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, ৫ ভাগের ৪ ভাগ লাশেরই পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন ও ছিন্নমূল অনেক মানুষ এখনো জাতীয় পরিচয়পত্রের আওতায় আসেননি। অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশের অধিকাংশই এসব মানুষের। লাশগুলোর একাংশ বয়সে তরুণ, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। এ ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ হাতের সাহায্যে কঠোর পরিশ্রম করে। অনেক সময় তাঁদের আঙুলের ছাপ মেলে না।
পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) মো. মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির রক্তসঞ্চালন না থাকায় আঙুল কুঁচকে যায়। তখন আঙুলের ছাপ মেলানো যায় না। পাশাপাশি ২০১০ সালের আগে যাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ মেলানো কঠিন। এসব কারণে অনেক লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায় না।
গত ২২ জানুয়ারি ঢাকার সাভার, ধামরাই ও ফরিদপুর থেকে এক নারীর খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়। সাভারে পাওয়া যায় মাথা ও হাত। হাত ও মাথা পোড়া অবস্থায় ছিল। পোড়া হাতের আঙুল থেকেই ছাপ সংগ্রহ করা হয়। ফলে ছাপ ছিল অস্পষ্ট। ওই অস্পষ্ট ছাপ জাতীয় পরিচয়পত্র ডেটাবেইসে ১১ নারীর আঙুলের ছাপের কাছাকাছি বলে শনাক্ত হয়।
ওই ১১ নারীর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁরা সবাই বেঁচে আছেন। এ কারণে নিহত ওই নারীর পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। ফলে রহস্য উদ্ঘাটনে বাধার মুখে পড়ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
পিবিআই কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের হাতে থাকা নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায় না। পরে লাশগুলো আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়; অথচ তাঁদের স্বজনেরা সারা জীবন প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষা করেন।