আতিকুর রহমান নগরী : রমজান মাসের শেষ শুক্রবার আজ, পবিত্র জুমাতুল বিদা। মুসলিম উম্মাহর কাছে রমজান মাসের শেষ শুক্রবার একটি পবিত্র দিন। রমজানকে বিদায় জানাতে এদিনে মসজিদগুলোতে বিশেষ মোনাজাতের ব্যবস্থা থাকে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরাও মনে করে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস রমজানের মহিমা জুমাতুল বিদার মধ্যদিয়ে আরও বেশি মহিমান্বিত হয়। রমজানের শেষ জুমা হিসেবে মুসলিম উম্মাহর কাছে দিনটির বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। রমজানের প্রতিটি জুমা ফজিলত ও তাৎপর্যের দিক থেকে অনন্য। বিদায়ী জুমা হিসেবে জুমাতুল বিদার মর্যাদা ও ফজিলত আরও বেশি। পবিত্র কুরআনে জুমার নামাজ আদায়ের তাগিদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি করো’-(সুরা জুমুআ)।
রোজা রাখা বা ঈদ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে আকাশে চাঁদ দেখা শর্ত। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে বা অন্য কোনো কারণে চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে।
জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ধর্মীয় উৎসব উদ্যাপন করে থাকি। বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সৌদি আরবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোজা রাখা ও ঈদ উদ্যাপন করে থাকেন কেউ কেউ। এর একটা প্রভাবও আমাদের সরলমনা মানুষের ওপর পড়ে থাকে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু আলোচনা করা হলো। যার দ্বারা বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে বলে ইসলামি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
১. ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী জীবনব্যবস্থা। এর কোনো বিধান বাস্তবতা পরিপন্থি নয়। তাই কুরআন হাদিসে কোনো বিধান বা বক্তব্য বাস্তবতাবিরোধী বলে মনে হলে এমন ব্যাখ্যা করতে হবে, যা বাস্তবসম্মত হয়। তা সম্ভব না হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। বাস্তবতাই তখন অগ্রাধিকার পাবে। এ নীতির আলোকে মুহাদ্দিসরা বলেছেন, কোনো হাদিসের ভাষ্য অকাট্য যুক্তি বা বাস্তবের বিপরীত হলে ওই হাদিসের সূত্র বাহ্যত বিশুদ্ধ মনে হলেও গ্রহণযোগ্য হবে না; বরং তা জাল বলে গণ্য হবে।
২. নামাজের সময়সূচি এবং রোজার ইফতার ও সেহরির সময়সূচিতে বিশ্বের সব মুসলমান বাস্তবতারই অনুসরণ করে আসছে। কুরআন ও হাদিসে ব্যাপকভাবে সম্বোধন করে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তোমরা অমুক অমুক সময়ে এই নামাজ আদায় করবে। তোমরা সূর্য অস্ত যাওয়ার পরই ইফতার করবে। সুবহে সাদিক হওয়ার আগেই সেহরি শেষ করবে। ঈদের নামাজের আগে নয়, পরে কোরবানি করবে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সম্বোধন করা হলেও এক স্থানের সময় অন্য স্থানের লোকের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অবাস্তব ধারণা কেউ পোষণ করে না। প্রতিটি দেশ ও অঞ্চলের লোক নিজ এলাকার সময়সূচি অনুসরণ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। সেহরির শেষ সময় ও ইফতারের সময়ও এভাবেই নির্ধারণ করা হয়।
৩. বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, শুধু রমজানের রোজার সূচনা এবং উভয় ঈদ উদ্যাপনের তারিখ নিয়ে। বিপরীতমুখী কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়ে এবং ফিক্হ গ্রন্থাদির কোনো কোনো শব্দের আশ্রয় নিয়ে বিশ্বের যেকোনো এক এলাকার চাঁদ দেখাকে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। অথচ কুরআন-হাদিসের কোথাও বিশ্বের সব মুসলমানকে কোনো এক বিশেষ স্থানের অনুসরণ করে একইদিনে রোজা শুরু করা বা ঈদ উদ্যাপনের নির্দেশ দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে শুধু এতটুকু বর্ণিত হয়েছে, ‘চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে তোমরা রোজা রাখা আরম্ভ করো, আবার চাঁদ দেখে তোমরা ইফতার করো (শাওয়াল মাসে ঈদ উদ্যাপন করো)।’ নামাজের সময়সূচি এবং রোজার ইফতার ও সেহরির সময়ের বর্ণনায় যেমন- ‘তোমরা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, এসব ক্ষেত্রে উল্লিখিত সম্বোধনগুলোর কারণে যদি বিশ্বের সব মুসলিমের একই সময়ে নামাজ পড়া বা সেহরি ও ইফতার খাওয়া জরুরি না হয়ে থাকে, তবে একইদিনে সবার রোজা রাখা আরম্ভ করা এবং একইদিনে ঈদ উদ্যাপন করা কোনো দলিল ও যুক্তির আলোকে অপরিহার্য হয়? অথচ এই বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে, বিভিন্ন দেশের দূরত্ব অনুযায়ী সেসব দেশের আকাশে চাঁদের জন্ম ও বিলীন হওয়ার মধ্যে এক বা দুই দিনের ব্যবধান হওয়া স্বাভাবিক। এ অবস্থায় এক স্থানকে কেন্দ্র করে রোজা রাখা শুরু করলে বা ঈদ উদ্যাপন করলে কোনো দেশে রমজান ২৮ দিনের এবং কোনো দেশে ৩১ দিনের হবে। অথচ সহিহ হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, চাঁদের মাস ২৯ বা ৩০ দিনের হয়, এর কম-বেশি হতে পারে না। বিশ্বের সর্বত্র একইদিনে রোজার সূচনা বা ঈদ উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত এ হাদিসের সরাসরি পরিপন্থি। একই সঙ্গে এ প্রশ্নও দেখা দেবে, রমজান ও ঈদ পালনের জন্য কোনো স্থানের চাঁদ দেখা বিশ্ববাসীর জন্য প্রযোজ্য হবে? কারণ কোনো হাদিসে অনুসরণীয় স্থান বা কেন্দ্রের উল্লেখ নেই। ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে এ পর্যন্ত কখনো কোথাও কোনো স্থানকে কেন্দ্র হিসেবে অনুসরণ করার নির্দেশ বা ব্যবস্থাও করা হয়নি।
৪. শরিয়তের হুকুম কোনো শর্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তা শুধু ওই সব লোকের ওপর প্রযোজ্য হবে, যাদের মধ্যে শর্ত পাওয়া সম্ভব। অন্যথায় অসম্ভব কাজ জোর করে চাপিয়ে দেয়া হবে, যা কোরআনে বর্ণিত ইসলামের স্পষ্ট নীতির পরিপন্থি। রোজা রাখা ও ঈদ উদ্যাপনের আদেশ চাঁদ দেখার সঙ্গে শর্তযুক্ত। সুতরাং যে এলাকার লোকদের পক্ষে যেদিন চাঁদ দেখা সম্ভব হবে, অন্তত কিছু লোকের মাধ্যমে চাঁদের অস্তিত্ব নিয়মানুযায়ী প্রমাণিত হবে, শুধু তাদের জন্য রোজা ও ঈদ উদ্যাপনের আদেশ প্রযোজ্য হবে। অন্য এলাকায় শর্ত প্রমাণিত না হলেও সেখানকার অধিবাসীদের রোজা ও ঈদ উদ্যাপনে বাধ্য করার ক্ষমতা শরিয়তে কাউকে কখনো দেয়া হয়নি। যেমন- আল্লাহ তায়ালা সক্ষম মুসলমানের ওপর হজ ফরজ করেছেন, দরিদ্রদের ওপর নয়। কিছু লোকের আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই বিশ্বের সব মুসলমানকে হজ পালন করতে হবে- এ কথা কেউ কখনো বলেননি।
৫. ‘হানাফি মত অনুযায়ী পশ্চিম প্রান্তের লোকের চাঁদ দেখা পূর্ব প্রান্তের লোকের জন্য প্রযোজ্য’- এ উক্তির সঠিক মর্মার্থ অনুধাবন করতে হবে। তা হলো-‘যে দেশ ও অঞ্চলে চাঁদ একইদিনে উদয় হওয়া সম্ভব, সেখানে শরিয়তের নিয়মানুযায়ী চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য উপায়ে প্রমাণিত হলে ওই এলাকার পূর্ব ও পশ্চিমের সব লোককে তা অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু এমন দূরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর তা কখনোই প্রযোজ্য হবে না, যেখানে সেদিন চাঁদ দেখা বাস্তবিক পক্ষে সম্ভব নয়।
আরো পড়ুন : ঈদে ছুটি পায়নি ডিএমপির ৭৫ শতাংশ জনবল, ঢাকার ১৬৩৬ ঈদ জামাত ঘিরে চার স্তরের নিরাপত্তা