একাত্তরের ডিসেম্বরে দিন যত এগোচ্ছিল বাংলার আকাশে ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছিল স্বাধীনতার সূর্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলার মানুষ তথা মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল। তাদের সহযোগিতা দিচ্ছিল মিত্রবাহিনী।
দুই শক্তির সম্মিলিত আক্রমণে পিছু হটতে থাকে পাকসেনারা। মুক্ত হতে থাকে একের পর এক জনপদ। আর মুক্তিসেনারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে থাকে মুক্ত এলাকাগুলোয়।
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ছিল শনিবার। এদিন ঢাকা ছিল উত্তাল। ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্যে ট্যাংকসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১১ ডিসেম্বর যশোরের মুক্ত এলাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- ১. ওয়ার ট্রাইব্যুনাল। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দিদের বিচার করবে। ২. ২৫ মার্চের আগে যারা যে জমি-দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ৩. সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। ৪. জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী নিষিদ্ধ করা হবে।
এদিকে এদিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আÍসমর্পণের প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব দেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এম এ মালেক। সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উলেখ করেন, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আÍসমর্পণের কথা জানিয়েছেন। এগুলো হলো- ১. পাকবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আÍসমর্পণ করবে। ২. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারা কোনো লিখিত চুক্তি করবে না। ৩. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে ফেরত যেতে দিতে হবে। ৪. পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দিতে হবে। ৫. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এসব এড়িয়ে পাকিস্তানকে যুদ্ধে সহায়তা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান। যদিও প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র শুধু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জোর দাবি জানায়। এদিন হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জানান, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক।
এদিন হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারা রাত যুদ্ধের পর ভোরের দিকে আÍসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী। তারা জামালপুর গ্যারিসন সম্মিলিত বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। হালুয়াঘাট এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর পাকবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় শত্রু বাহিনী বড় বড় সব সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। অপরদিকে ময়মনসিংহে অবস্থানরত শত্রু বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনা প্রতিরোধে জামালপুর দখল করে।
আরো পড়ুন : আজ ১১ ডিসেম্বর, রহনপুর মুক্ত দিবস