আমার সোনার টুকরো ছেলেটাকে মেরে ফেলা হলো

ওকে নিউজ স্পেশাল ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ পুরুষ পুরুষ অধিকার পুরুষ নির্যাতন প্রচ্ছদ মুক্তমত শিক্ষা হ্যালোআড্ডা

সরকারি চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতার জীবন বেছে নিয়েছিলেন কাজী নূর উদ্দিন। তাঁর স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী। স্বল্প আয়ের সংসারে তিন ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে জীবনবদলের স্বপ্ন বুনেছিলেন তাঁরা। সে কারণে নারায়ণগঞ্জের পাগলা এলাকায় নিজেদের বাড়ি থাকলেও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে ছেলেদের লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছিলেন। এই দম্পতির বড় ছেলে ফারদিন নূর ওরফে পরশ। ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়। তিন দিন আগে নিখোঁজ হন তিনি।

ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক বলেছিলেন, এই তরুণকে হত্যা করা হয়েছে। ৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া বস্তিতে ফারদিনের মুঠোফোনের সর্বশেষ অবস্থান দেখা গেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফারদিনের এক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে এ হত্যারহস্য এখনো বের করতে পারেনি তারা।

ঘটনার তিন সপ্তাহ পরও এ ঘটনার তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এ পরিস্থিতিতে কথা হয় ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিনের সঙ্গে। ছেলের বেড়ে ওঠা, লেখাপড়ার প্রতি একনিষ্ঠতা, খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এসব নানা বিষয় তুলে ধরেন তিনি।

কাজী নূর উদ্দিন জানান, তিন ভাইয়ের মধ্যে ফারদিন ছিল সবার বড়। ঢাকায় এসে তাঁরা কখনো মিরপুর, কখনো পেয়ারাবাগ এলাকায় থেকেছেন। একপর্যায়ে এসে থিতু হন ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায়। তিনি বলেন, ‘এখানকার একটি অখ্যাত স্কুল থেকে আমার ছেলে আজ বুয়েট ছাত্র। এ জন্য আমরা যেমন গর্বিত, একইভাবে তার স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরাও তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেন।’

ফারদিন চতুর্থ শ্রেণি থেকেই নিজের মতো রুটিন করে পড়াশোনা করতেন জানিয়ে তাঁর বাবা বলেন, ‘একটা খুব মজার ব্যাপার ছিল যে আমি যখন বাইরে থেকে বাসায় ফিরতাম, আমার ছোট দুই ছেলে ব্যাগে খাবার খুঁজত। আর ফারদিন ব্যাগে খুঁজত বই ও পত্রিকা আছে কি না। আমার ব্যাগে বই ও পত্রিকা না পেলে ওর মন খুব খারাপ হয়ে যেত।’

পড়ার প্রতি ফারদিনের আগ্রহের কথা তুলে ধরে নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলেটা পুরোপুরি একজন পাঠক ছিল। স্বপ্ন ছিল মৃত্যুকালে যেন ওর একটাই পরিচয় থাকে “আ রিডার” বা একজন পাঠক।’

বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠান বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পেছনে ফারদিনের নিজের চেষ্টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করেন তাঁর বাবা। তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্যের কারণে আমরা যতটুকু না খেয়াল রাখতে পেরেছি, ফারদিন আসলে নিজেই নিজেকে তৈরি করেছে। সে ছিল সংগ্রামী, অদম্য মেধাবী, যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলতে পারত।’

ফারদিন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই বই পড়তে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আবৃত্তি শিখতেন তিনি। এসব তথ্য জানিয়ে তাঁর বাবা বলেন, ‘সন্তানদের তিলে তিলে গড়ে তুলতে ওর মা তার জীবনের সমুদয় কষ্ট মেনে নিয়েছিল। ওর মা বলত, আমাদের কষ্টের দিন শেষ হয়ে আসছে। ছেলের জন্য মা এখন শুধু কান্না করে, আর বলে কারা আমার ফারদিনকে মারল কিচ্ছু জানতে পারলাম না। ফারদিনের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ভিডিও দেখে ওর মা কান্না করে।’

পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্ভাস কোচিং সেন্টারে পড়াতেন ফারদিন। ছিলেন বিতার্কিক। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর স্পেনের মাদ্রিদে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কথা ছিল। ফারদিন খুবই সময়ানুবর্তী ছিলেন জানিয়ে তাঁর বাবা বলেন, ‘আমার ছেলেটার ২৩ বছর ৫ মাস ৯ দিন পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু দশম দিনে এসে এক বন্ধুর সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা থাকার পরে আমার ছেলেটা নিরুদ্দেশ হলো। আমার সোনার টুকরো ছেলেটাকে মেরে ফেলা হলো।’

ফারদিনকে নিয়ে প্রচারিত বিভিন্ন খবরে অসন্তোষ জানান বাবা কাজী নূর উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা রিকশায় চললে ভাড়া দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় চালককে ধন্যবাদ জানাত। আমি জানি না কতজন এমন করে। আমার এমন ছেলেটা মারা যাওয়ার পরও আমি জানি না কারা বিভ্রান্তি ছড়াল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রমাণ ছাড়া এমন সব তথ্য দিল, সেটা খুবই বেদনাদায়ক। সেটা বড় বিস্ময়।’

আরো পড়ুন : শেষ ষোলোয় নেইমারবিহীন ব্রাজিল

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *