প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশনের সাক্ষাৎ, জি এম কাদেরকে জোটে না রাখার আহ্বান ♦ তারা সরে পড়তে পারে : ওবায়দুল কাদের ♦ রওশনের সাক্ষাৎ ভোটে প্রভাব ফেলবে না : চুন্নু
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আর মাত্র তিন দিন বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা না হওয়ায় জাতীয় পার্টিতে (জাপা) উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট ও সমঝোতা করে ভোট করা এ দলটি আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এরই মধ্যে আসন সমঝোতার লক্ষ্যে একাধিক বৈঠক করেছে। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আগামী ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এদিকে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় পার্টি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে সরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
দলীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির কেউই নৌকা প্রতীকের সঙ্গে নির্বাচনি মাঠে লড়াই করতে সম্মত নন। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও মাঠে দেখতে চান না তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে গিয়ে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে জাতীয় পার্টির সঙ্গে যেন আওয়ামী লীগের কোনো প্রকার জোট করা না হয়, প্রধানমন্ত্রীকে সে অনুরোধ করেছেন রওশন এরশাদ। তবে বৈঠক প্রসঙ্গে পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশন এরশাদের এ বৈঠক নির্বাচনের বিষয়ে মনে হয় না মাঠে খুব একটা প্রভাব পড়বে। এ অবস্থায় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পাটির অস্বস্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির এক কো-চেয়ারম্যান বলেন, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির আসন সমঝোতা হবেই। আশা করছি, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হবে। একাধিক বৈঠক হলেও সমঝোতা চূড়ান্ত হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে ওই কো-চেয়ারম্যান বলেন, দলের পক্ষ থেকে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তা এখন শুধু আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমরা যেসব আসন আওয়ামী লীগের কাছে চাচ্ছি, তাদের শক্তিশালী প্রার্থী ছাড়াও ১৪ দলের শরিক, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, ইসলামী দলসহ ভোটে অংশ নেওয়া প্রায় সব দলের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। সব দল বিবেচনায় নিয়ে একসঙ্গে আসন ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। সেজন্য সমঝোতায় দেরি হচ্ছে।
জানা যায়, বর্তমান সংসদের জাতীয় পার্টির বেশকয়েকজন সংসদ সদস্যকে এবার ছাড় দিতে চাইছে না স্থানীয় আওয়ামী লীগ। তারা বলছেন, একই আসনে বারবার ছাড় দেওয়া হলে আসনটিতে দল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাছাড়া যেসব এমপির নির্বাচনি এলাকায় শক্ত সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড় দিতে নারাজ।
ফেনী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবুল বশর বলেন, তিনবার টানা মনোনয়ন পেয়েও জোটগত কারণে আওয়ামী লীগের সিটটি অতীতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই আসনে জোটের কোনো দলের অস্তিত্ব নেই। আসনটি এবার আমরা চাই। আওয়ামী লীগ ও জাপা সূত্রে জানা গেছে, ভাগে পাওয়া আসনে জয়ের নিশ্চয়তা পেতে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র সব প্রার্থীর প্রত্যাহার চাইছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসন ধরে ধরে আলোচনায় আগ্রহী নয়। জাপার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জয়ী হতে সর্বাত্মক সহায়তা করা হবে এটুকু আশ্বাস দিচ্ছে। এ ছাড়া ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে বলছে।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টির নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এতে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেননি তিনি। জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে দলটির নেতারা একাধিকবার আমির হোসেন আমুর সঙ্গে বৈঠক-সাক্ষাৎ করেছেন। ১০ থেকে ১২টি দলের শীর্ষ নেতাদের আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী থাকবে না এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আসন ছাড়ের বিষয়ে নিশ্চয়তা তিনি দেননি। এ বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলাপ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন। এরপর গত বুধবার রাতে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে গুলশানের একটি বাসায় বৈঠক করেন। গত শনিবার রাতেও আবার বৈঠক হয় দুই পক্ষের। তবে এতে ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন না। জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বৈঠকগুলো করা হচ্ছে অত্যন্ত গোপনীয়তায়। বৈঠকের স্থান ও সময় কাউকে জানানো হচ্ছে না। বৈঠকে কারা অংশ নিচ্ছেন এবং কী আলোচনা হচ্ছে, তা যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্যই এই গোপনীয়তা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কৌশল চূড়ান্ত করার বিষয়টি অনেকটাই আটকে আছে জাপায়। কারণ, জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচন হলে একধরনের কৌশল নিতে হবে। আর জাপা একা নির্বাচন করলে আরেক কৌশল। আওয়ামী লীগ ও জাপা সূত্র বলছে, জাপা অন্তত ৩৫-৪০ আসনে নিশ্চয়তা চাইছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ জাপাকে আলাদা নির্বাচন করে বিএনপির ভোট টানতে পরামর্শ দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশনের বৈঠক : জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট না করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। গতকাল দুপুরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে তাঁকে এই অনুরোধ জানান। বৈঠক শেষে বেরিয়ে রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জি এম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন। নির্বাচন নিয়ে জি এম কাদেরের কর্মকান্ডে আমার সমর্থন নেই। আমার ছেলের জায়গায় উনি ইলেকশন করছেন।’ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছেন কি না জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘এখন তো আর সময় নেই।’ এ সময় বৈঠকে অংশ নেওয়া বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, রওশন এরশাদ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তাঁর মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদ জানান, রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি (রওশন) বলেছেন জি এম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন। সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সুকৌশলে তাঁকে, সাদ এরশাদকে ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সরিয়ে দিয়েছেন। দলের মধ্যে ‘ক্যু’ করে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। জাতীয় পার্টির সঙ্গে যেন কোনো জোট না হয় সে জন্য রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন বলেও জানান কাজী মামুনুর রশিদ। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, আমাদের যেসব লোক মনোনয়ন পাননি, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের জাতীয় পার্টি হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে জোট করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব’। সাদ এরশাদ বলেন, যেখানে মা বেঁচে আছেন, আমিও সুস্থ, আমি রংপুর-৩ আসনের বর্তমান এমপি। আমাকে মনোনয়ন না দিয়ে উনি (জি এম কাদের) দাঁড়িয়েছেন। এটা ঠিক করেননি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা শুনেছেন।
বৈঠক নির্বাচনে প্রভাব পড়বে না : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের বৈঠক প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে রওশন এরশাদ কী বলেছেন, আর প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন এটা তাদের বিষয়। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। জোট বা আসন ভাগাভাগিতে আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। আমরা জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে নিজের মতো করে নমিনেশন দিয়েছি এবং নিজের মতো করে নির্বাচনে যাচ্ছি। নির্বাচন বলেন আর যা কিছুই বলেন আমাদের একটি দল আছে, দলের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী আমরা সব কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাজেই আমাদের নির্বাচনের বিষয়ে মনে হয় না মাঠে এর খুব একটা প্রভাব পড়বে। গতকাল বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে জি এম কাদের চেয়ারম্যান হয়েছেন। সেখানে ক্যু করার সুযোগ কোথায়? ক্যু তো হলো কাউকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আসা। জি এম কাদের কাউন্সিলের মাধ্যমে এসেছেন। তিনি বলেন, আমরা রওশন এরশাদ, সাদ এরশাদ ও আরও একজনের মনোনয়নপত্র প্রস্তুত করেছিলাম। তিনজনের জন্য মনোনয়ন নিয়ে আমরা শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত তাদের জন্য অপেক্ষা করেছি।
নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টির সরে যাওয়ার আশঙ্কা : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নাও করতে পারে- এমন আশঙ্কা আছে। আমাদের দলের অনেকের মাঝে যেমন এই আশঙ্কা, তেমনি দেশের জনগণের মাঝেও আছে। গতকাল বিকালে তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট দফতর বিষয়ক উপ-কমিটির মতবিনিময় সভা শেষে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক কিছুই সম্ভব। নির্বাচন বয়কট করা, ওয়াকআউট করা এসব বিষয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সব জায়গাতেই আছে। তবে শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটি এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।