ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে বানানো হচ্ছে স্থায়ী দোকান

অনুসন্ধানী জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ

ভেতরে স্টিলের অবকাঠামোর ওপর একটি ঘর। ঘরের ভেতরে তিনটি কক্ষ, মেঝেতে ঝকঝকে টাইলস। এসব কক্ষ ব্যবহার হচ্ছে গুদাম ও রান্নাঘর হিসেবে। আর একটু দূরে টিন ও কাঠের আরেকটি অবকাঠামো তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে খাবার।

এটি কোনো অভিজাত বা ব্যবসায়ী এলাকার চিত্র নয়। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে দেখা মিলবে এই দৃশ্যের। পুরান ঢাকার প্রায় ১৮ লাখ মানুষের নির্মল বায়ু নেওয়ার একমাত্র পার্কটির ভেতরে এখন এভাবেই চলছে খাবার বিক্রির দোকান।

এ নিয়ে স্থানীয় সচেতন মহল প্রতিবাদ জানালেও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা যায়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল-৪-এর অধীনে এই পার্কটিতে ‘ফুড ভ্যান’ ইজারা দিলেও গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা।

ইজারাদার পার্ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন এমন শর্ত দেওয়া হলেও সরেজমিনে পার্কের বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। ফুড ভ্যানের আকৃতি কেমন হবে, তা ইজারাদারকে দেওয়া করপোরেশনের কার্যাদেশে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা আছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৪-এর প্রকৌশল বিভাগের নির্ধারিত পরিমাপ অনুযায়ী ফুড ভ্যান নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় কার্যাদেশ বাতিলসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অথচ অঞ্চল-৪-এর প্রকৌশল বিভাগ বলছে, এই বিষয়টি ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ দেখেছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ইজারাদারকে ভ্রাম্যমাণ দোকান তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এমনভাবে দোকান তৈরি করতে বলা হয়েছিল, যাতে তা যেকোনো সময় স্থানান্তর করা যায়। কিন্তু ইজারাদার স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করেছেন।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) মো. রাসেল সাবরিন বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা কারো কাছ থেকে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। আমরা ফুড ভ্যানের জন্য ইজারা দিয়েছিলাম। নকশাটি অঞ্চল-৪-এর প্রকৌশল বিভাগ দেখে দিয়েছে, তারা বলতে পারবে।’

ডিএসসিসির অঞ্চল-৪-এর সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ লুত্ফর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা নকশা দেখিনি। এটি সম্পত্তি বিভাগ বলতে পারবে। ইজারা সম্পত্তি বিভাগ দিয়ে থাকে।’

ইজারার শর্ত ভঙ্গের ব্যাপারে ইজারা প্রতিষ্ঠান ডিএআর হোল্ডিং লিমিটেডের কর্ণধার ফারুক আলম বলেন, ‘আমরা তো রাস্তায় বসা দোকানের মতো করে করতে পারি না। এটি সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়েই পরিষ্কার এবং সুন্দর মনোরমভাবে খাবার উপস্থাপনের মতো পরিবেশ করা হয়েছে। আসলে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা না বলে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বললেই ভালো হবে।’

খাবারের দোকান সরানোর দাবি জানিয়ে ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক ও পার্কের ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব আক্তারুজ্জামান খান বলেন, ‘মুনাফার জন্য পার্ক নয়। পার্ক হচ্ছে জনগণের নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পুরান ঢাকার প্রায় ১৮ লাখ মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। ভোর হলেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাসহ হাজার হাজার লোক এই পার্কে শরীরচর্চার জন্য আসে।’

সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘পার্কটিকে করপোরেট বানিয়ে ফেলা হয়েছে। মানুষ বসতে পারে না, হাঁটতে পারে না। মন খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো পরিবেশ নেই। আমরা আন্দোলন করছি। আন্দোলন আরো বড় হচ্ছে। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী সমিতিসহ সবাইকে নিয়ে আমরা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলছি।’

পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘পুরান ঢাকায় সাংস্কৃতিক চর্চা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক ঘিরে। এই একটি জায়গা, যেখানে স্থানীয়রা একটু নিঃশ্বাস নিতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই। পাশেই যে ধূপখোলা মাঠ ছিল, সেটিও এখন আগের মতো নেই। সেখানে মার্কেট বানানো হয়েছে। আর এখন বাহাদুর শাহ পার্কের অর্ধেক অংশ দখল করে খাবারের দোকান বানানো হয়েছে। এটি নগরের পরিবেশগত ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হবে না। পার্কের ভেতরে এ ধরনের স্থাপনা সমর্থন করা যায় না। কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’

বাহাদুর শাহ পার্ক আগে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় ভিক্টোরিয়া পার্ক বিশেষ পরিচিতি অর্জন করে। এখানে কয়েকজন বিদ্রোহীকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৮৫৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার বিপুলসংখ্যক মানুষের এক সমাবেশে রানি ভিক্টোরিয়ার বিখ্যাত ঘোষণা পাঠ করেন। সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর শাসন পুনরায় আনার জন্য। তাই তাঁর নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।

বাহাদুর শাহ পার্কের আয়তন ৮৫.৩ কাঠা। এই পার্কের চারপাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজসহ অন্তত ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এই পার্ক ব্যবহার করে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, সাঈদ খোকন মেয়র থাকার সময় প্রায় ছয় কোটি ৬৮ লাখ টাকা খরচ করে পার্কটি সংস্কার করা হয়। সংস্কারকাজ শেষে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে পার্কটির নবরূপের উদ্বোধন করা হয়।

আরো পড়ুন : বাংলাদেশে ১৫ লাখ ক্যানসার রোগীদের অর্ধেকই চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *