ইটিভি’র জন্য আমার সংগ্রামটা যেন শেষ হওয়ার নয়!

ওকে নিউজ স্পেশাল টেলিভিশন তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ বিনোদন মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

আব্দুস সালাম : বাংলাদেশের প্রথম টেরিস্ট্রিয়াল টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) জন্য আমার সংগ্রামটা যেন শেষ হওয়ার নয়। বারবার স্টেশনটি দখল হয়েছে। জেল খেটেছি। দেশ ছাড়াতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সংগ্রাম ছাড়িনি। সংগ্রামটি একুশের জন্য, মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য।

২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর একুশের জন্য একটি কালো দিবস। ওই দিন পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপের নেতৃত্বে এস আলম গ্রুপ ইটিভি দখল করে নেয়। তার প্রায় এক বছর আগে রাতে আমি ইটিভি ভবন থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠার সময় আমাকে আটক করা হয়। আমি প্রায় তিন বছর জেলে ছিলাম।

আটকের পর আমার বিরুদ্ধে সাতটি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। রিমান্ডে নেওয়া হয়। জেলে নেওয়ার পর আমার ওপর নির্যাতন চালানো হয় ইটিভির মালিকানা দখল নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি বলেছিলাম, আমার আঙুল কেটে ফেলা হলেও কোনো কাগজপত্রে সই করব না। আমাকে মাথা নোয়াতে ব্যর্থ হয়ে তারা নানা ধরনের জাল কাগজপত্র তৈরি করে। আমার জেলজীবনের প্রায় এক বছরের মাথায় ওই জাল কাগজপত্র দিয়ে ইটিভি দখল করা হয়। আসলে এর নেপথ্যে ছিলেন পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা।

আমি চেষ্টা করতাম সব সময়ই স্বাধীন সাংবাদিকতার। ২০১৪ সালে নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছিল, সেটা ইটিভিতে দেখানো হয়। নির্বাচনে একতরফাভাবে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা, ভোটে কারসাজির চিত্র নিয়ে আমরা ইটিভিতে ব্যাপক প্রচার করতে থাকি। তখনই শেখ হাসিনা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হন। এরপর আমি বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন থেকে দেওয়া বক্তৃতা লাইভ সম্প্রচার করি ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি। তখন তারা আমাকে আটকের একটা অজুহাত পেয়ে যায়। ৬ জানুয়ারি ভোররাতেই আমাকে আটক করে। আমাকে জেলে নেয় এবং আমার ছোট ভাইসহ ইটিভির কয়েকজনকে ডিজিএফআইর লোকজন আটক করে নির্যাতন চালায়।

আমাকে আটকের পর ইটিভি দখলের প্লট তৈরি করে সরকার। আর সেই ষড়যন্ত্রে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং কিছু সাংবাদিক জড়িত ছিল। শেখ হাসিনার তখনকার বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপের নেতৃত্বে এস আলম গ্রুপ ইটিভি দখল করে নেয় ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর। দখলের আগে তারা সর্বশেষ বৈঠক করে ইটিভির উল্টো দিকে হোটেল সোনারগাঁওয়ে। ইটিভি দখলে সামনে ছিলেন ডিজিএফআইর তখনকার কর্মকর্তা কমান্ডার এম সোহায়েল। পেছনে কলকাঠি নাড়েন ওই সংস্থার আরও কিছু কর্মকর্তা। দখলে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের মহাসচিব কে এম শহীদুল্লাহ এবং এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা। একুশে দখলের পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বনে যান আবদুস সোবহান গোলাপ। নির্বিচারে চাকরিচ্যুত করা হয় একুশের কর্মীদের। বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশজুড়ে, মুক্তখবর, জনতার কথা, একুশের চোখসহ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। আর স্টেশনটির মূল্যবান যন্ত্রপাতি, সম্প্রচার সামগ্রী লুটপাট করা হয়। ইটিভিকে পরিণত করা হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দালালির স্টেশনে। মুক্ত সাংবাদিকতা বিদায় নেয় ইটিভি থেকে।

এখানে দুঃখের সঙ্গে একটি কথা বলতে চাই, আমাকে আটকের পর সারা দেশে একুশের সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করলেও আওয়ামীপন্থি সাংবাদিক সংগঠন বা নেতারা কোনো প্রতিবাদ করেননি। উল্টো তাদের অনেকেই আমি যাতে জেল থেকে বের হতে না পারি, তার ষড়যন্ত্র করে।

আর ওই জিজিএফআইর কর্মকর্তারা তখন পদোন্নতি পান। সোহায়েলকে করা হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। ৫ আগস্টের পর তিনি গ্রেপ্তার হন। এখন কারাগারে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ যেমন মুক্তি পায় তেমনি দখল হওয়া ইটিভিও মুক্ত হয়। ওই দিন একুশের কর্মীরা আমাকে একুশে টেলিভিশনে নিয়ে আসেন। জাতি মুক্তির স্বাদ পায়। একুশে টেলিভিশনও পায় মুক্তির আস্বাদ। আমরা এখন নতুন যাত্রা শুরু করেছি। আমার অঙ্গীকার হলো, ইটিভি স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে এগিয়ে যাবে। একুশের যে সংগ্রামী চরিত্র তা বহাল থাকবে।

শেখ মুজিবুর রহমানও বাকশাল কায়েম করে দু-একটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার মেয়ে শেখ হাসিনাও একুশে টিভি দখল করে একই পথে হেঁটেছেন। একুশে টিভি দখল ছিল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে বড় হামলা। কিন্তু স্বৈরাচাররা টিকে থাকে না। বাংলাদেশের এই নতুন যাত্রা, একুশের নতুন যাত্রা তার প্রমাণ। ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল একুশে টিভির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ২০০২ সালেও ইটিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর সংগ্রাম করে আমরা ফের অন-এয়ারে আসি ২০০৭ সালে। আর সর্বশেষ স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কোপানলে পড়ে ২০১৫ সালে। কিন্তু একুশে কখনো মাথা নোয়ায়নি। আমার সংগ্রাম কখনো বন্ধ হয়নি। স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য একুশের এই সংগ্রাম কখনোই থামবে না। আমাকেও থামানো যাবে না।

লেখক : চেয়ারম্যান ও সিইও, একুশে টেলিভিশন

আরো পড়ুন : রাজসিক সংবর্ধনা পেল সাফজয়ী ৬ কিশোরী ফুটবলার

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *