স্টাফ রিপোর্টার : ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে তোপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তার ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’- শীর্ষক বইটিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের। বিষয়টি নিয়ে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। তারা প্রফেসর ইমতিয়াজের অপসারণ দাবি করেছে। এ দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে সংগঠনটি। এদিকে অভিযোগের পর নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিবৃতি দিয়েছেন প্রফেসর ইমতিয়াজ। যারা এ অভিযোগ সামনে এনেছেন তারা হয়তো তার বক্তব্যের সারবস্তু উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি বলেও দাবি করেন তিনি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, অভিযোগের বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টির পরিচালক প্রফেসর ফকরুল আলমকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে একটি নিবন্ধন লেখেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। যার শিরোনাম ছিল- ‘ঢাবি অধ্যাপকের বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর উপর অমার্জনীয় লেখনী’। এ লেখায় তিনি প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদের বইটির বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরেন। নিবন্ধনের শুরুতেই শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক লেখেন, ‘গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইত্যাদি বিষয়ে যিনি নিজেই অজ্ঞতা এবং ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত, তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাবেন? তিনি নিশ্চয়ই জেনোসাইড সেন্টারে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং গণহত্যা নিয়ে ভ্রান্তিকর, উদ্ভট এবং মনগড়া কথাই শেখাবেন।’ তিনি লেখেন, ‘যে ক’টি বিষয় আমার ভিমরি খাওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল, তার একটি হলো তার লেখা এই যে, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তার ভাষণ শেষ করেছিলেন।’ এ লেখায় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বইটিতে উঠে আসা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ, বিহারি হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে আনেন। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে দেয়া এক স্মারকলিপিতে বইটির বেশ কিছু অসঙ্গতি উল্লেখ করে। এতে বলা হয়, বইটির ৪০ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রফেসর ইমতিয়াজ লিখেছেন, তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজে হাজির হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় পাকিস্তান’- বলতে শুনেছেন। ওই বইয়ে প্রফেসর ইমতিয়াজ বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি। এতে আরও বলা হয়, প্রফেসর ইমতিয়াজ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি চরম অবমাননা করে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, একটি মৌলিক প্রশ্ন হলো, আসলেই কি ত্রিশ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, নাকি মৃতের সংখ্যা কম ছিল? জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আমরা জানতাম উনি জ্ঞানী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। কিন্তু তিনি বইটিতে যেসব তথ্য তুলে এনেছেন তা ইতিহাসের স্পষ্ট বিকৃতি। তিনি তার এক পাকিস্তানি বান্ধবীর অনুপ্রেরণায় বইটি লেখেছেন। ইচ্ছা করেই ইতিহাসের বিকৃতি করেছেন। বইটি প্রকাশ হয়েছে ১৪ বছর আগে। আমরা এখন পড়ে এতে ইতিহাসের এসব বিকৃতি পেয়েছি। আমরা আমাদের দাবিতে অবিচল। আমরা চাই রাষ্ট্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুসহ ইতিহাসের প্রামান্য দলিল বিকৃতি যারাই করবে তাদের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হবো। আমরা রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাই যারাই এ ধরণের কর্মকাণ্ড করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে অনেকে আমাদের ইতিহাসের বিকৃতি করে। আমরা চাই জার্মানির হলোকাস্ট আইনের মতো একটি আইন বাংলাদেশেও হোক। যারাই ইতিহাসের বিরোধিতা করে মনগড়া বক্তব্য দেবে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
প্রফেসর ইমতিয়াজের বিবৃতি এদিকে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগের বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বিবৃতি দিয়েছেন প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ। রোববার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, যে বইটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টার প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে রচিত, তাতে ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকেই অস্বীকার কিংবা এর গুরুত্ব কমিয়ে দেখানো কীভাবে সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় আমি আশ্চর্য হয়েছি। আমি মনে করি, কোথাও বইয়ের কোনো কোনো অংশ বুঝতে ভুল হয়েছে কিংবা ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। তিনি বলেন, এটাও মনে রাখা দরকার যে, এখন থেকে ১৪ বছর আগে জোনোসাইডের জন্য দায়ীদের বিচারের দাবি নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য-পরিসংখ্যান ব্যবহার করে খুব বেশি লেখালেখি হতো না। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ গণহত্যার এপিসেন্টার হিসেবে পরিচিত, সেখানেও এ ধরনের গবেষণার আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছিল না। আমার গ্রন্থ এবং অন্যান্য লেখালেখিতে জেনোসাইড-১৯৭১ নিয়ে ধারাবাহিক ও নিবিড় গবেষণার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তিনি আরও বলেন, বইয়ের কোথাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অসম্মান বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন হতে পারে- এমন একটি শব্দও নেই। এমনটি হতে পারে যে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিষয়ে আমার একটি মন্তব্যের সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। তারা হয়ত আমার বক্তব্যের সারবস্তু উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি।
তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। এটা আমাদের আবেগের জায়গা। প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ১৪ বছর আগে প্রকাশিত বইটি পড়ে অভিযোগের প্রমাণ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরো পড়ুন : ডয়চে ভেলে-নেত্র নিউজের সঙ্গে যৌথ ডকুমেন্টারি সংবাদদের তথ্য ভুয়া: র্যাব