অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বৃহত্তম আল-শিফা হাসপাতালে বৃহস্পতিবার রাতেই হামলা চালিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।
জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে হাসপাতালের জেনারেটর ব্যবস্থা। এ অবস্থায় রোগীরা এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। আর মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছে ইনকিউবেটরের ৪৫ শিশু।
এরই মধ্যে হাসপাতালের আইসিইউ লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। হাসপাতালে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ বন্ধেই ডাক্তারদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু আইডিএফ তাতে ভ্রুক্ষেপ করছে না।
এ পরিস্থিতিতে রিয়াদে ইসলামিক বিশ্বের নেতারা গাজায় সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। খবর আলজাজিরা, রয়টার্স, বিবিসির।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র শনিবার রয়টার্সকে বলেছেন, আল-শিফা হাসপাতালের ইনকিউবেটরে থাকা এক শিশু ইতোমধ্যে মারা গেছে।
গাজার উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইউসেফ আবু আলরিশ বলেছেন, হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার বৃহত্তম আল-শিফা হাসপাতালের ইনকিউবেটরে ৪৫টি নবজাতক শিশু রয়েছে। ইসরাইলি স্নাইপাররা হাসপাতালের চারদিকে অবস্থান নিয়েছে। আকাশ থেকে ড্রোন তাক করে রাখা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে কেউ বের হওয়ার চেষ্টা করলেই সেনারা তাকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ইসরাইল হাসপাতালের আইসিইউ লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের এলোপাতাড়ি গুলিতে সেখানে হতাহতের আশঙ্কা করা হলেও সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। হামলার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হাসপাতালে এখন ‘হ্যান্ড ভেন্টিলেশন’র মাধ্যমে রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আর আইসিইউতে থাকা নবজাতক শিশুরা অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে শুরু করেছে বলে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে।
বিবিসি জানিয়েছে, আল-শিফা হাসপাতাল থেকে কয়েকজন রোগী বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের মরদেহ হাসপাতাল চত্বরে পড়ে আছে।
আলজাজিরাকে আলরিশ বলেছেন, ‘আমাদের ইনকিউবেটরে ৪৫টি নবজাতক আছে। এই শিশুরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। আমরা বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছাড়াই এখানে পড়ে আছি। আমরা মৃতদের দাফনও করতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘কেউ হাসপাতালের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে পারছে না। ড্রোন ছাড়াও স্নাইপাররা সব জায়গায় মোতায়েন রয়েছে। তারা চলন্ত কাউকে দেখলেই তাকে গুলি করে হত্যা করছে।’
গাজার এই মন্ত্রী বলেন, সর্বত্রই রক্ত। মেঝেতে রক্ত। এমনকি আমরা তা পরিষ্কারও করতে পারছি না। ইসরাইলি কিলিং মেশিন হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে এবং টেলিভিশনের পর্দায় তা দেখানো হচ্ছে। এখনও তারা একই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। কিন্তু কেউ শুনছে না, কেউ দেখছে না। সারা বিশ্ব ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল কাইলা গাজার হাসপাতালে সাদা ফসফরাস ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন। গাজায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এটা আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ বস্তু। তারপরও আল-শিফা হাসপাতালে সাদা ফসফরাস ব্যবহারের জন্য কে ইসরাইলকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে?
তিনি বলেন, ইসরাইলের বাহিনী গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। অকাল মৃত্যুই গাজার হাসপাতালের রোগীদের অদৃষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ জন্য আমরা ইসরাইল, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়ী করছি।
শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একজন মুখপাত্র বলেছেন, আল-শিফা হাসপাতাল বোমা হামলার কবলে পড়েছে। ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় গাজার ২০টি হাসপাতাল বর্তমানে অচল হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে গাজার হাসপাতালগুলোতে যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন খান ইউনিসে অবস্থিত আল নাসের হাসপাতালের এক চিকিৎসক।
তিনি বলেন, সমগ্র বিশ্বের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, সেখানে যদি কোনো বিবেকবান কেউ থেকে থাকেন, দয়া করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। বিশ্বের কোনো রাজনীতিবিদ যদি এটা বন্ধে চাপ দিতে না পারেন, তবে তার হাতও রক্তে রঞ্জিত। তিনি বলেন, হাসপাতালে দ্বার খোলা। কিন্তু আমরা রোগীদের সেবা দিতে পারছি না। এভাবে আমরা যুদ্ধপরাধ চলতে দিতে পারি না।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) গাজার হাসপাতাল ইসরাইলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে হাসপাতালের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধের লক্ষ্যে নিয়ে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ও আরব বিশ্বের সম্মেলনে ইসরাইলের ওপর তেল ও পণ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। শনিবার এই সম্মেলনে ইসলামিক দেশগুলোর নেতারা সবাই গাজায় ইসরাইলের হামলা বন্ধের দাবি জানান।
সম্মেলনে অংশ নিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘ইসরাইলকে প্রতিহত করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ইসরাইলকে প্রতিহত করায় আমরা হামাসের হাত চুম্বন করি।’
মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি বলেন, ‘আত্মরক্ষা বা কোনো কিছুর অজুহাতে’ গাজার সাধারণ মানুষকে সমষ্টিগত শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেন, ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আয়োজন করতে হবে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গাজায় হামলা বন্ধে ইসরাইলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
সম্মেলনের আয়োজক সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি এবং সব জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়া তিনি বলেছেন, গাজার মানুষের ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে সেটি মেনে নেওয়া যায় না। গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের জন্য তিনি ইসরাইলকে দায়ী করেন।
কাতারের আমিরও সম্মেলনে ইসরাইলের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, হামাসের কমান্ড সেন্টার থাকার মিথ্যা দাবি করে ইসরাইল গাজার হাসপাতালগুলোতে হামলা চালাচ্ছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
আরো পড়ুন : ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বুরকান ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করেছে হিজবুল্লাহ