ফিলিস্তিনের সামনে এখন এক ক্রান্তিকাল। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হয়েছে মাত্র। কিন্তু বছরের শুরুতেই ইসরায়েলি বন্দুকযুদ্ধে ইতোমধ্যে নিহত হয়েছে ৩৫ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে ৯ জন জেনিনে অনুপ্রবেশ করেছিল। তাদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব একজন নারীও আছেন। পূর্ব জেরুজালেমে সহিংস ঘটনায় নিহত হয়েছে সাত ইসরায়েলি। আর উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বহিরাগত বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ।
এ সহিংসতার মধ্যেই নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ১৯৩০ দশকের নাৎসি জার্মানি আমলের স্মৃতিচারণ করেন। আর এ স্মৃতিচারণের সময় একদল লোক ‘সন্ত্রাসীদের মৃত্যু চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। তিনি জেরুজালেমে দুই ব্যক্তিকে আহত করার জন্য ১৩ বছর বয়সী এক অভিযুক্ত কিশোরসহ সহিংস হামলায় জড়িত অন্যান্য ফিলিস্তিনির ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলার নীতিকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছেন। এ নীতি অনুসারে বিগত ২০১৪ সাল থেকে ধ্বংস করা হয়েছে প্রায় ৭৫টি বাড়ি। এমনকি এ সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু এ ঘটনার বিপরীতে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়াগুলো মৌলিকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যখনই ইহুদি কেউ ফিলিস্তিনিদের হাতে হত্যার শিকার হয়, তখনই নানা রকম শোরগোল ও বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু যদি ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে, সেরকম ঘটনায় বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। এ ধরনের বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ার কারণে ইসরায়েল দায়মুক্ত হওয়ার একটি অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যাচ্ছে। এর মানে ইসরায়েলের চরমপন্থি প্রশাসন বিশ্বাস করে যে, তারা যে কোনো কিছু করলেও তার কোনো দায় তাদের ওপর থাকছে না। কারণ তারা সব ধরনের দায় থেকে মুক্ত।
ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু এর মধ্যেই এক বিভ্রান্তিকর আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি শান্তি স্থাপনের জন্য ফিলিস্তিনিদের ‘মাঝে’ যেতে পারেন। মানে ফিলিস্তিনিদের ছাড়াই যে কোনো সুনির্দিষ্ট নিষ্পত্তি হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে কিছু চুক্তিও করেছেন। সেগুলো নিয়ে তিনি গর্বিতও। কিন্তু ইসরায়েল কখনো সুদান, বাহরাইন বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি এবং তাদের ভূখণ্ডের এক ইঞ্চি জমিও চুরি করেনি বা করতে পারেনি। তাহলে এ ধরনের চুক্তি কীভাবে শান্তির প্রতিনিধিত্ব করে? যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহারা অঞ্চল এবং কিছু ঋণ ছাড়ের বিষয়ে মরক্কো ও সুদানকে এক ধরনের ঘুষ দিচ্ছে। এর ফলে সম্পর্কগুলোর অর্থবহ এবং সুদূরপ্রসারী কোনো উন্নতি আদৌ কি হবে?
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান সম্প্রতি আরব বিশ্বের সঙ্গে সত্যিকারের শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে ইসরায়েলের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ন্যায়সংগত প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তার এক বক্তব্যে তিনি বলেন, সত্যিকারের স্বাভাবিকীকরণ এবং স্থিতিশীলতা শুধু ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমেই আসবে।
মিশর ও জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েল একটি কৃত্রিম শান্তিচুক্তি করেছে। কিন্তু এ কৃত্রিম চুক্তি প্রমাণ করে যে, প্রকৃত অর্থে শান্তি অর্জিত হয় জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে, নেতাদের মধ্যে নয়। আশির দশকে মিশরীয় ও জর্ডানের জনগণ ইসরায়েলের সঙ্গে যতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, এখন সেই সম্মিলন আর নেই বললেই চলে। শান্তিপ্রিয় জনগণ এখন ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায়বিচার চায়। অন্য কিছু, যেমন যৌথ উদ্যোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময় বা পর্যটনের মতো কোনো ব্যাপারে তাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
বেনজামিন নেতানিয়াহুর ‘আরব’ নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। বরং তার সমস্যা ‘সভ্যতা’ নিয়ে। বর্তমান বিশ্ব বর্ণবাদ, বর্বরতা ও জাতিগত হত্যাকে সমর্থন করে না। মার্কিন কংগ্রেস এবং মিডিয়া একসময় ইসরায়েলকে এ ব্যাপারে বৈধতা দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিল। কিন্তু সময়ের ফেরে এ বৈধতাটি দেওয়া হয়ে ওঠেনি। আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুর এ সুদীর্ঘ মেয়াদ ইসরায়েলকে একঘরে রাষ্ট্র হিসেবেও চিহ্নিত করছে।
তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য নেতানিয়াহুর দৃষ্টিভঙ্গি তার চরম ডানপন্থি মন্ত্রিসভার মিত্রদের সঙ্গে তুলনা করলে অসাধারণভাবে উপকারী বলে মনে হয়। তারা মনে করেন, ফিলিস্তিন মূলত তাদের জন্য ঈশ্বরের উপহারস্বরূপ। তাই তাদের মতে, ফিলিস্তিনিদের উচিত যে কোনো উপায়েই হোক না কেন, এ ভূখণ্ডটিকে তাদের ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণরূপে খালি করে দেওয়া।
নেতানিয়াহুর অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি হচ্ছে ইসরায়েলের বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দেওয়া। এটা গণতন্ত্রের ওপর এক ধরনের আক্রমণও বটে। ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো ইসরায়েলি আদালত কখনোই ন্যায়বিচার প্রদান করেনি। কিছু ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটিয়েছে মাত্র। যেমন বাড়িঘর উচ্ছেদ, জমি কেড়ে নেওয়া এবং অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার—এসব ক্ষেত্রে বিচারেরবাস্তবায়নে কিছুটা বিলম্ব ঘটেছে বা বিচার পাল্টে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিবিদরা বিচার বিভাগে নিজেদের লোকবল নিয়োগ করার অধিকার পেয়েছিলেন এবং তাদের সহকারীরা যে কোনো বিচার বাতিল বা প্রভাবিত করার অনুমতি পেয়েছিল। এভাবে নেতানিয়াহু এবং তার মিত্রদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসরায়েলের বিচার বিভাগকে জরাজীর্ণ একটি উপাঙ্গে পরিণত করা।
মূলত তারা আরও সামনে এগিয়ে যেতে চায়। তারা চায় এ বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আরব রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে দাঁড়ানো থেকে নিষিদ্ধ করতে। তাদের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে, নাগরিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া। এ ছাড়া তারা আরও চেষ্টা করছে নাগরিকত্বের অধিকারকে সংকুচিত করে ফেলতে। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহরে সহিংস ঘটনাগুলোকে আরও উসকে দিতে তারা বিরামহীন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এসব ব্যাপার খোদ ইসরায়েলের ভেতরেই ব্যাপক বিক্ষোভ হচ্ছে। এ ধরনের অন্যায্য পদক্ষেপগুলো বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তেল আবিবের একজন শিক্ষাবিদ ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি নিবন্ধে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল একটি ‘উদারহীন, অগণতান্ত্রিক, ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একটি বিপদস্বরূপ’।
গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সমান প্রশাসনসহ মূল গণতান্ত্রিক নীতি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সমান অধিকার, আইনের শাসন, মুক্ত সংবাদমাধ্যম ও একটি শক্তিশালী সুশীল সমাজ গঠনে তাদের সহায়তা থাকবে।
তবে এখানে কোনো দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে। আবার এ সম্ভাবনার সঙ্গে আরেকটি সম্ভাবনাও উঁকি দেয়—তাহলে কোনো ধরনের একক রাষ্ট্রবিষয়ক সমাধান কি আবির্ভূত হতে পারে? একটি একক রাষ্ট্র হবে এমন যেখানে সব নাগরিক সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হয়ে উঠবে বিশ্বব্যাপী এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এর বিপরীতটি প্রত্যক্ষ করছি—একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র তৈরি হচ্ছে যেখানে আরব এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন অ-নাগরিক হয়ে উঠছে।
ফিলিস্তিনে আরবদের সংখ্যা সম্ভবত ইহুদিদের তুলনায় কিছুটা হলেও বেশি। এ ছাড়া ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু নেতানিয়াহুর শাসন ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো মূল্যই নেই, তাই নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর একটি নিপীড়নমূলক বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
অনেকেই যুক্তি দিতে পারেন যে ইসরায়েল এই মুহূর্তে একটি পরিবর্তনমূলক সময় অতিক্রম করছে। কিন্তু ব্যাপার যাই হোক, নেতানিয়াহুর নব্য-ফ্যাসিবাদী জোট এরই মধ্যে একটি গতি অর্জন করে ফেলেছে এবং না ফেরার পথে এগিয়ে চলেছে দৃঢ়তার সঙ্গে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য এ ব্যাপারটি খুব সাধারণ। তাদের শান্তি স্থাপনের জন্য কোনো অংশীদার নেই। নেই কোনো দ্বিরাষ্ট্র স্থাপনের সমাধান। শুধু শান্তিপূর্ণ নাগরিক বিদ্রোহের মাধ্যমেই তারা নিজেদের ভূখণ্ড ফিরে পেতে পারে।
অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত উভয়পক্ষের এক ধরনের অমানবিকতা ও অবহেলাকে আরও উসকে দিয়েছে। বেন-গভিরের চরম ডানপন্থি বসতি স্থাপনকারী আন্দোলন এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে; যেখানে ফিলিস্তিনিদের নৃশংসতার ফাঁদে ফেলে হত্যা করা যেতে পারে। আবার এ ঘটনার ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র ঘৃণা এবং প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের পক্ষে যোগ্য নেতাদের অনুপস্থিতির কারণেও একটি নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দিচ্ছে। তবে ফিলিস্তিনের আরবরা যদি শান্তিপূর্ণ নাগরিক প্রচারণা শুরু করে, তাহলে নেতানিয়াহুর সরকারের কুৎসিত, নৃশংস চেহারা আরও স্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হবে।
লেখক : একজন পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক এবং মিডিয়া সার্ভিসেস সিন্ডিকেটের সম্পাদক।
সুত্র: আরব নিউজ
আরো পড়ুন : জেনে নিন জুমার দিন কোন পাঁচ ভুল করা যাবে না