নিউফাউন্ডল্যান্ডের প্রত্যন্ত উপকূলে সমুদ্রের নিচে দুই মাইলেরও বেশি গভীরে, একটি জাহাজের কঙ্কাল এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মানুষের কল্পনাকে উজ্জীবিত করে রেখেছে। জাহাজে মরচে ধরেছে, ক্ষয় হচ্ছে, কিন্তু এখনো এর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারেন না ইতিহাসবিদ থেকে অনুসন্ধানকারীরা। টাইটানিক বই, চলচ্চিত্র, ভিডিও গেমের আলোচিত বিষয় হওয়ার পাশাপাশি গবেষকদের কয়েক দশক ধরে অনুসন্ধান ও বিতর্কের সুযোগ করে দিয়েছে। সাতটি জাদুঘরে টাইটানিকের স্মৃতি আজও অমর হয়ে আছে এবং নিদর্শনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকদের আকর্ষণের বিষয়। আটলান্টিকের গভীরে ডুবে যাওয়ার একশ’ এগারো বছর পরেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিশালাকার জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আজ শিরোনাম তৈরি করে: ধ্বংসাবশেষের নতুন ছবি প্রকাশিত হয়, প্রতিলিপি তৈরি করা হয়, উদ্ধার মিশন চালু করা হয়।
দুর্ভাগ্যজনক যাত্রা
গত রোববার, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য পাঁচ অভিযাত্রীকে নিয়ে একটি ডুবোজাহাজ নিখোঁজ হয়ে যায়। শুরু হয় চিরুনি তল্লাশি যা বুধবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অভিযাত্রীরা ঙপবধহএধঃব ঊীঢ়বফরঃরড়হং দ্বারা পরিচালিত একটি ট্রিপের অংশ ছিল, এটি একটি প্রাইভেট কোম্পানি যেটি ২০২১ সাল থেকে পর্যটকদের সমুদ্রযাত্রায় নিয়ে যায়। একেক ব্যক্তির খরচ পড়ে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। গভীর সমুদ্রে যাত্রীদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগ পেয়েছে। রাফায়েল আভিলা, নিজের টিকটক অ্যাকাউন্টে টাইটানিকের গল্প শেয়ার করে লিখেছেন – ‘আমাদের অনেকের কাছে এটি একটি জাহাজের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।’
একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে
টাইটানিক এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মানব ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
যার জ্বলন্ত প্রমাণ পরিচালক জেমস ক্যামেরন ও তার কিংবদন্তি ছবি। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার ব্লকবাস্টার ছবিটি চতুর্থ-সর্বোচ্চ আয়কারী ছবি ছিল। ইন্ডিপেন্ডেন্টের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে একথা বলেছিলেন পরিচালক। গবেষকরা বলছেন, এই মুগ্ধতা যাত্রীদের টাইটানিকের প্রতি নিবিড় আগ্রহের ফল। টাইটানিকের ইতিহাসবিদ ডন লিঞ্চ বলেছেন, ‘এটি একটি অকল্পনীয় গল্প: বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজটি তার প্রথম সমুদ্রযাত্রায় ডুবে গিয়েছিল। জাহাজটি ধনী এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। যাত্রাকালে এটি একটি হিমবাহে আঘাত করে এবং ডুবে যায়। ছবিতে সবটাই তুলে ধরা হয়েছে’।
টাইটানিক সম্পর্কে কিছু কথা
টাইটানিক ১৯১২ সালের ১৫ই এপ্রিল আটলান্টিক মহাসাগরে গভীর রাতে একটি হিমবাহে আঘাত করার পরে ডুবে যায়। প্রায় ১৫০০ যাত্রী মারা যায় এবং প্রায় ৭০০ জনকে উদ্ধার করা হয়। অসংখ্য প্রচেষ্টার পর ১৯৮৫ সালে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল থেকে প্রায় ৩৭০ মাইল দূরে এবং ১২,৫০০ ফুট পানির নিচে। অন্যান্য জাহাজের ধ্বংসাবশেষ যেগুলো মারাত্মক সত্ত্বেও ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু টাইটানিক আজ স্বমহিমায় বিদ্যমান। রেডিও এবং ফটোগ্রাফির ব্যবহারের মাধ্যমে ট্র্যাজেডিটি উন্মোচিত হয়েছিল এবং ইতিহাসের একটি গভীর কূপ খনন করেছিল যা মানুষকে কয়েক দশকের অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিয়েছে। গবেষকরা বলেছেন: কীভাবে এবং কেন জাহাজটি ডুবেছিল, কোথায় এবং কখন এটা দুই ভাগে ভেঙে গেল এবং সমুদ্রে হারিয়ে গেল তা সত্যিই বিস্ময়।
নাটকের থেকে কোনো অংশে কম নয়
সান দিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং ‘দ্য টাইটানিক স্টোরি: হার্ড চয়েস, ডেঞ্জারাস ডিসিশনস’-এর লেখক স্টিফেন কক্স বলেছেন, ‘এটি এমন কিছু বিপর্যয়ের মধ্যে একটি যাতে মানুষের পছন্দের নাটকের সব রকম রসদ উপস্থিত। সাধারণত যখন একটি জাহাজ ডুবে যায় তখনই তার সমাপ্তি হয়ে যায়। টাইটানিক ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ধরে চলেছিল, যা শেক্সপিয়ারের নাটকের মতো দীর্ঘ।’ এই গল্প অনেকদিন ধরে জনসাধারণের কল্পনাকে ধরে রেখেছে। প্রথম চলচ্চিত্রটি বিপর্যয়ের ২৯ দিন পরে প্রকাশিত হয়েছিল; সবচেয়ে সাম্প্রতিক একটি চাইনিজ ডকুমেন্টারি, ‘দ্য সিক্স’, ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি একটি সম্পূর্ণ অনলাইন রেফারেন্স গাইড, ‘এনসাইক্লোপিডিয়া টাইটানিকা’ তৈরি করা হয়েছে। টাইটানিক নিয়ে উৎসাহী লোকেরা ক্লাব এবং ফ্যান পেজ তৈরি করেছেন।
একটি অন্তহীন গল্প
টাইটানিক মিউজিয়াম অ্যাট্রাকশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কিউরেটর পল বার্নস বলেছেন ‘এটি একটি শেষ না হওয়া গল্প। যারা সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন এবং যাদের সেদিন মৃত্যু হয়েছিল টাইটানিক তাদের সকলের কথা বলে।’ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার মতোই টাইটানিকের প্রতি মানুষের স্থায়ী মনোযোগ আজও বিদ্যমান। দুটি একই সময়ের ব্যবধানে উন্মোচিত হয়েছিল এবং তাদের শেষ মুহূর্তগুলো কী হতে পারে সে সম্পর্কে বিশাল সংখ্যক মানুষের আগ্রহকে ধরে রেখেছিল। টাইটানিক এবং ৯/১১- এই বিপর্যয়গুলো, তাদের ভয়াবহতার জন্য নয়, বরং তারা সেই মানুষগুলোর সত্যিকারের লড়াইয়ের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
ধ্বংসাবশেষের প্রতি টান
কোনো কোনো মানুষ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে মুগ্ধ এবং জাহাজটির ডুবে যাওয়া নিয়ে গবেষকরা আজও অধ্যয়ন জারি রেখেছেন। টাইটানিক হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির ইতিহাসবিদ লিঞ্চ- এর মতে, আজও মানুষ সেই সময়ে জাহাজে উপস্থিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে চায়। এটি এমন একটি আধুনিক সময়ে ঘটেছে যে বর্তমান প্রজন্ম এটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হতে পারে। কার্পাথিয়া জাহাজের যাত্রীরা টাইটানিক থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর জীবিত যাত্রীদের ছবি তুলেছিলেন সাংবাদিকরা। শিল্প বিপ্লবের সময়ে জাহাজটির বিলাসবহুল সমুদ্রযাত্রার প্রতীক ছিল। কিন্তু জাহাজটির হঠাৎ ডুবে যাওয়া ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। কারও কারও জন্য জাহাজ ধ্বংসের স্থানটি গল্পের মতোই মুগ্ধতা রাখে। ক্যামেরন, যিনি একাধিকবার সেখানে ভ্রমণ করেছেন, বলেছেন ধ্বংসাবশেষ হলো ‘মানুষের গল্প যা আমাদের অনেক কিছু শেখায়।’
নিথর সময়
ক্যামেরন ২০০৫ সালের সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন -‘আমরা পানির নিচে এই সাইটগুলো পরিদর্শন করে ইতিহাসকে স্পর্শ করতে পারি।’ লিঞ্চ, যিনি ক্যামেরনের ডকুমেন্টারির জন্য ধ্বংসাবশেষের স্থানটি ভ্রমণ করেছিলেন, অভিযানটিকে মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বছর ৩৩ এর আভিলা যিনি ঞরশঞড়শ-এ ‘টাইটানিক গাই’ নামে পরিচিত- তার জাহাজটির প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল ৭ বছর বয়সে। তিনি একটি জাহাজ ধ্বংসের তথ্যচিত্র দেখেছিলেন এবং তার বাবা তাকে টাইটানিক সম্পর্কে বলেছিলেন। কয়েক মাস পরে যখন ক্যামেরনের সিনেমা বের হয়, তখন আভিলা তার বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ছবিটি দেখতে যান। পরে তিনি লাইব্রেরি থেকে বইয়ের স্তূপ নামিয়ে পড়তে শুরু করেন। আভিলা জানাচ্ছেন, ‘আমার স্ত্রী যখন আমার সঙ্গে প্রথম ডেটিং শুরু করে তখন সে জানতো আমার প্রথম ভালোবাসা আসলে কি।’
নতুন প্রজন্মের দর্শক
আভিলা এখন টিকটকে নতুন প্রজন্মের ভক্তদের সঙ্গে টাইটানিকের গল্প শেয়ার করেন। ২০২০ সালে কোভিড মহামারির সময় থেকে তিনি উৎসাহী শ্রোতাদের গল্প শুনিয়ে চলেছেন। তার প্রথম টাইটানিক ভিডিওটি এপ্রিল মাসে, টাইটানিক ট্র্যাজেডির বার্ষিকীতে তৈরি করা হয়েছিল। তিনি চার্লস জঘিনের গল্পটি তুলে ধরেছিলেন, একজন বেকার যিনি বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে মদ্যপানকে সঙ্গী করেছিলেন। আনস্ক্রিপ্ট করা ভিডিওটি ২ মিলিয়ন বার দেখা হয়েছিল। আজ, আভিলার ভিডিওগুলো ৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ অনুসরণ করছেন। ভিডিওগুলো দুর্ঘটনা সম্পর্কে তত্ত্বগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। বিলাসবহুল লাইনারের বৈশিষ্ট্যগুলোকে স্পটলাইট করার পাশাপাশি সমুদ্রের তলদেশে ধ্বংসাবশেষের ছবি শেয়ার করা হয়েছে ভিডিওগুলোতে। এই নতুন টিকটক শ্রোতাদের মধ্যে টাইটানিক সম্পর্কে জানার অমোঘ আগ্রহ প্রমাণ, করে টাইটানিকের সলিল সমাধি হলেও ইতিহাস এই জাহাজকে কখনো ভুলে যাবে না। টাইটানিক তখনও মানুষকে মুগ্ধ করতো, আজও মানুষকে মুগ্ধ করে।
সূত্র: গালফ নিউজ