ওমান থেকে বুধবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে বাড়িতে পা রাখেন নারায়ণ দাশ। চারদিকে তখন মাতম। বাড়ির কাছে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স। সেখানে চির ঘুমে আছেন নারায়ণ দাশের স্ত্রী, চার সন্তান ও ভাইপো। স্বজনেরা এগিয়ে এসে তাঁকে সান্ত্বনা দেন। কিন্তু নারায়ণের মুখে কোনো কথা নেই, বাক্রুদ্ধ। শোকে পাথর। আবার কখনো আর্তনাদ করে উঠছেন।
দুপুর ১২টার দিকে সৎকারের জন্য প্রস্তুত করা হয় মরদেহগুলো। একে একে জ্বলে ওঠে সব কটি চিতা। আর কান্নায় ভারী হয়ে আসে পরিবেশ।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাটহাজারীর চারিয়া এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নারায়ণের স্ত্রী রীতা দাশ ও সন্তানেরাসহ সাতজন মারা যান। চন্দনাইশ থেকে তাঁরা রীতার বাবার বাড়ি ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার শাহনগর এলাকায় যাচ্ছিলেন। সেখানে মঙ্গলবার রীতার দাদি কনকলতার আদ্যশ্রাদ্ধ ছিল। এখন নিজেরাই শোকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন সবার জন্য।
সাতজনের লাশ মঙ্গলবার রাতেই পৌঁছে গেছে চন্দনাইশ উপজেলার জোয়ারা ইউনিয়নের মোহাম্মদপুরের নিজ বাড়িতে। সাতজনের মধ্যে নারায়ণের বোন চিনু দাশের বাড়ি পাশের সাতবাড়িয়া এলাকায়। তাঁকে মঙ্গলবার রাতেই সেখানে নিয়ে সৎকার করা হয়। স্ত্রী-সন্তানদের মুখ শেষবারের মতো দেখানোর জন্য ওমানপ্রবাসী নারায়ণের অপেক্ষায় ছিলেন বাড়ির লোকজন।
তবে পরিচিত মুখগুলো তখন দেখার মতো অবস্থায় ছিল না। দুর্ঘটনায় স্ত্রী রীতা, দুই যমজ ছেলে দীপ ও দিগন্ত, মেয়ে শ্রাবন্তী ও বর্ষা কিংবা ভাইপো বিপ্লবের চেহারাও যে বিকৃত হয়ে গেছে। স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা ধরে অ্যাম্বুলেন্সের পাশে নিয়ে যান নারায়ণকে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন নারায়ণ ও পাড়া-প্রতিবেশীরা।
একসময় নারায়ণ ছুটে যান উঠানের এক কোণে বসা তাঁর অসুস্থ মেজ ভাই নিহত বিপ্লবের বাবা শম্ভু দাশের কাছে। তাঁকে জড়িয়ে কান্নার আরেক দৃশ্য। সেই কান্না সংক্রমিত হয় বাড়িজুড়ে থাকা স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে।
শুধু কি পাড়া-প্রতিবেশী, নারায়ণের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে শ্রাবন্তী ও বর্ষার স্কুলের সহপাঠী-শিক্ষকেরা ভিড় করেন। ভিড় করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজন। সবার চোখে পানি।
উঠানের এক পাশে রীতা দাশের বাবা মিলন দাশ বসে আছেন। সদ্য মায়ের শ্রাদ্ধ সেরে ফিরেছেন তিনি। মিলন দাশ বলেন, ‘মায়ের শ্রাদ্ধে বসে মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের মৃত্যুর খবর পাই। তখন মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।’
নারায়ণের বাড়িতে উপস্থিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা বেগমসহ সবাই ব্যথিত এমন ঘটনায়। উপজেলা প্রশাসন থেকে ছয়জনের জন্য ২৫ হাজার করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হস্তান্তর করা হয় পরিবারকে। সৎকারের জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে দেওয়া হয় ৮৫ হাজার টাকা।
এদিকে দুর্ঘটনায় হাটহাজারী থানায় একটি মামলা হয়েছে। নারায়ণের ভাইপো পলাশ দাশ বাদী হয়ে বাসের চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে মামলাটি করেন বলে নাজিরহাট হাইওয়ে থানার পরিদর্শক আদিল মাহমুদ জানান। তবে এখনো বাসচালককে আটক করা যায়নি।
আরো পড়ুন : আমার স্ত্রী পুলিশ গুলি মারল কেন? সেতো একজন সাধারণ গার্মেন্টসকর্মী!