এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেরিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। দুই সন্তান হারিয়ে শোকে-দুঃখে অভিমানে ঢাকা ছাড়ছেন শিশু আরাফাত হোসেন রাউফ ও ইসনাত জাহান রাইদার বাবা-মা। রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের বাসার দ্বিতীয় তলাতে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতির।
পেশায় রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ী ইব্রাহিমের পুরো বাসাজুড়ে এখন শুধুই হাহাকার! শূন্যতা! দীর্ঘদিন ধরে এই ভাড়া বাসায় বসবাস করলেও সন্তানদের হারিয়ে ইতিমধ্যে বাড়ির মালিককে বাসা ছাড়ার বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন তারা। যেখানে রাউফ কিংবা রাইদা নেই সেখানে আমরা কীভাবে থাকবো। আমরা বাঁচবো না। পাগল হয়ে যাবো। আমাদের আর বাঁচার কোনো অবলম্বনই রইলো না- এভাবেই কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। বাসার সামনে বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করলেও কারোর সঙ্গেই কথা বলতে চাইছিলেন না শোকগ্রস্ত ইব্রাহিম। মা রাবেয়া আক্তার বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন।
মধ্য পাইকপাড়া বাসার কাছেই আইকন একাডেমি নামে একটি স্কুলে রাউফ কেজিতে আর রাইদা নার্সারিতে পড়তো। রাউফের বয়স ছিল ৯ বছর। আর রাইদার ছিল সাড়ে ৬ বছর। আইকন স্কুলেও যেন শোকের ছায়া নেমেছে। শিক্ষকরা ইতিমধ্যে শোক প্রকাশ করেছেন।
শিশু দুটির বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, আমার দুই ছেলে-মেয়েই ঘুরতে যেতে ভালোবাসতো। আমরাও ওদের আবদার কখনো অপূর্ণ রাখিনি। প্রতি শুক্রবার আমরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ওদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। সন্তানদের এই শখ পূরণ করতে গিয়ে আমি কখনো টাকা-পয়সার চিন্তা করিনি। গাড়ি ভাড়া দিয়ে যা আয় হতো তার পুরোটাই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা-শখ পূরণে খরচ করতাম। হেমায়েতপুরে আমার একটু জমি রয়েছে। নিজের গাড়ি আছে। এতেই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে কী থেকে কী হয়ে গেল। সবকিছু এখন পর্যন্ত আমার কাছে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাই। যেখানে যাওয়ার পর রাউফ অনেক খুশি হয়। ও সমুদ্রের পানিতে বার বার গোসল করতে চাচ্ছিলো। ঢাকায় ফেরার আগে জানায়, রাউফ আরেকবার গোসল করতে চায়। আমরা ওকে বাধা দেইনি। প্রতি সপ্তাতে দুদিন বাদেই রাইদা মাকে বলতো মা শুক্রবার কবে আসবে। আমরা রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো। অসুস্থ হওয়ার আগেও আমাদের পরিকল্পনা ছিল নতুন একটি রেস্তরাঁয় খেতে যাবো। সেটা আর হলো না। রাইদার প্রিয় পুতুল, রাউফের রং পেনসিল, বইখাতা, জামা-জুতা, স্কুলব্যাগ সবই পড়ে আছে। নেই শুধু রাউফ আর রাইদা।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ই আগস্ট রাউফ এবং ২৫শে আগস্ট রাইদা মারা যায়। রাউফকে সাভারের হেমায়েতপুরে কবর দেয়া হয়। ভাই মারা যাওয়ার পর রাইদা বলেছিল বাবা আমরা আর ঢাকায় ফিরবো না। ওখানে অনেক মশা। ওখানে ডেঙ্গু। ভাইয়া নেই। আমরা এখন আর ওখানে যাবো না। সাভারেই থাকবো। বেঁচে থাকতে বাবার দুই বাহুতে যেভাবে দুই সন্তান পাশাপাশি ঘুমাতো মৃত্যুর মধ্যদিয়েও রাউফ-রাইদা এখন পাশাপাশি কবরে শুয়ে আছে। ইব্রাহিম বলেন, আমার ছেলের হাতের লেখা খুব ভালো ছিল। ওকে ফার্মাসিস্ট বানানোর স্বপ্ন দেখতাম। মেয়ে রাইদা বড় হয়ে একজন ভালো চিকিৎসক হবে। সাধারণ মানুষের সেবা করবে। রাইদাকে প্লাস্টিকের চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনে দিতাম। যেগুলো দিয়ে মেয়ে আমার ডাক্তার ডাক্তার খেলতো। তিনি বলেন, আমার জীবনে কোনো অভাব দেখিনি। কোনো অপ্রাপ্তি ছিল না। এখন আমি সর্বহারা।
ইব্রাহিম বলেন, গত ১৪ই আগস্ট রাউফের হালকা জ্বর আসে। ১৫ই আগস্ট স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়। পরদিন ১৬ই আগস্ট রক্তের পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে কিন্তু প্লাটিলেট ভালো থাকায় চিকিৎসক রাউফকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু পরদিন ১৭ই আগস্ট ওর প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকে এবং ১৮ই আগস্ট হাসপাতালে ভর্তির আগেই রাউফ না ফেরার দেশে চলে যায়। ওকে চিকিৎসা করানোর কোনো সুযোগই পাইনি। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর রাতে হেমায়েতপুরে মাটি দিয়ে বাসায় ফেরার পর মেয়ের শরীর খারাপ দেখে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডেঙ্গু পজিটিভ আসে।
একটি শয্যা পেতে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ঘুরেছি। এভাবে প্রায় ৫ থেকে ৬টি হাসপাতালে ঘুরেছি। হাসপাতালে শয্যা নেই, শিশুদের পিআইসিইউ নেই। মাঝরাতে পাগলের মতো ঘুরেছি। আশা ছাড়িনি। রাইদাকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের পিআইসিইউতে পাঁচ দিন রাখার পর বাসায় আনি। আনার পরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেখান থেকে ডেলটায় নিয়ে যাই সেখানে শয্যা না পেয়ে আরেক হাসপাতালে যাই সেখান থেকে সবশেষ মহাখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের পিআইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ওখানে চিকিৎসকরা জানায়, আপনার সন্তানকে আগে যে হাসপাতালে রেখেছেন সেখানে কোনো চিকিৎসাই করা হয়নি। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় ডেঙ্গুর কারণে রাইদার লিভার এবং কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই হাসপাতালে সাতটি ইনজেকশন দেয়ার কথা বলেছিল। দুটি ইনজেকশন দেয়াও হয়। এরপর ২৫শে আগস্ট মেয়েকে চোখের সামনে আইসিইউতে নিয়ে যায়। সকালে রাইদা মারা গেল।
হতভাগা এই পিতা বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ কী? আগে যাও কমবেশি আসতো। ওষুধ ছিটাতো। চারপাশ পরিষ্কার কিনা খোঁজ নিতো। এখন তাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। আমাদের মতো আর কোনো মা-বাবার বুক যেন খালি না হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য সন্তানকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিটি হাসপাতালে দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়েছে। চিকিৎসকরা পর্যন্ত সঠিক চিকিৎসা দেয়নি। অথচ টাকা খরচ করেও সন্তানদের বাঁচাতে পারলাম না। এমন মৃত্যু যেন আর কোনো বাবা-মাকে দেখতে না হয়।
রাউফ ও রাইদার স্কুল আইকন একাডেমির শিক্ষক এসএম মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের স্কুলের ২০ বছরের ইতিহাসে আমরা এমন মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হইনি। একটি পরিবারের দুটি শিশু এভাবে চলে যাবে এটা আমরা মানতে পারছি না। গত ১৬ই আগস্ট রাউফ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। জানায় আমার শরীর খারাপ। ওর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। পরে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে আমরা খবর পেলাম রাউফ মারা গেছে। পরদিন ওর জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এর ৭ দিন পর রাইদার মৃত্যুর খবর পেলাম। আমরা বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না।
আরো পড়ুন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল থেকে ছাত্রকে বের করে দিল ছাত্রলীগ