এমপির ছোঁয়ায় আয়া থেকে মুক্তা রাণী এখন শত কোটি টাকার মুক্তা সেন

অনুসন্ধানী অর্থনীতি ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ তথ্য-প্রযুক্তি দুর্নীতি নারী প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি স্বাস্থ্য কথা হ্যালোআড্ডা

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের ছোঁয়ায় আয়া থেকে অবৈধ পন্থায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মুক্তা রাণী। এক সময় ভাড়া বাসায় বসবাস করলেও এখন নিজেরই রয়েছে কয়েকটি বাড়ি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তা রাণী (৪৫)। বাবা পেঁচা সরকার চন্ডিপুর বাজারে এক সময় চায়ের দোকান করতেন।
চন্ডিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পাস মুক্তা রাণীর স্বামীর মৃত্যুর পর ২০১০ সালে সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আয়া পদে চাকরি নেন।

স্থানীয়রা জানায়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আয়া পদে চাকরি করার সময়েই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চা, পানি পরিবেশন করার সুবাদে পরিচয় হয় ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের সাথে। আর ধীরে ধীরে তার ছোঁয়ায় আয়া থেকে হয়ে যান শহরের বড় ঠিকাদার ও শত কোটি টাকার মালিক। তবে ১৬ আগস্টে এমপি রমেশ চন্দ্র সেন আটক হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন মুক্তা।
চার বছর আয়া পদে চাকরির পর ২০১৪ সালে চাকরি ছেড়ে দেন মুক্তা।

অভিযোগ রয়েছে এমপি রমেশ চন্দ্র সেনের ছোট স্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন মুক্তা রাণী। কেউ কেউ মজা করে ছোট কাকি বলেও ডাকতেন। মুক্তা রাণী থেকে নাম পরিবর্তন করে হয়ে ওঠেন মুক্তা সেন।

ধীরে ধীরে শুরু হয় মুক্তা সেনের কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার গল্প। ২০১৪ সালে আয়া পদে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর ঠিকাদারি খাতায় নাম লেখান মুক্তা। শুরু হয় ঠিকাদারি ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে যার বর্তমান নাম ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। টেন্ডার ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে হাসপাতালের যাবতীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাবার সরবরাহ, স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য করে আঙুল মাত্র কয়েক বছরেই শতকোটি টাকার মালিক হয়ে যান মুক্তা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তা রাণীর ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, গাড়ির শোরুম, ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ইসলামবাগ মহল্লায় দুই তলা বিশিষ্ট বিশাল বাড়ি, শান্তিনগরে প্লট আকারে ৫ শতক করে দুটি জমি, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলএসডি গোডাউনের পাশে ১০ শতক জমি, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে নামিদামি রেস্টুরেন্ট, সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাদুপাড়ায় বাড়ি-জমি ও সয়াবিন তেলের কারখানা, চন্ডিপুরে বাড়ি, মিল-চাতাল ও পুকুর ছাড়াও রয়েছে ১০ একর আবাদি জমি।

সদর উপজেলার গড়েয়া বাসস্ট্যান্ডে ৮ শতক জমির ওপরে বাড়ি। এছাড়া তিনি নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখলসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি ও বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার। তিনি এতো টাকার মালিক হয়েছেন যে, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নওগাঁর অটো রাইস মিল কয়েক কোটি টাকায় কিনে নেন এই মুক্তা।

চলতি বছরে মুক্তার দুই ছেলে তূর্য ও মাধুর্য এন্টারপ্রাইজ নামে পূবালী ব্যাংক হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৩৮ লাখ ২০৯৯ টাকা। সাবেক মন্ত্রী ও এমপি রমেশ চন্দ্র সেন আটক হওয়ার পর দিন সব টাকা তুলে নেন তিনি। এছাড়াও জনতা, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে তাদের হিসাব নম্বরে গত দুবছরে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বড় ভাই নারায়ন ঠাকুর ভারতে চলে যান। পরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা সদর মহুকুমার অন্তগর্ত ময়নাগুড়ি পৌরশহরে জমি ক্রয় করে বাসাবাড়ি করেন। তিনি ভারতেরও একজন নাগরিক। পরে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং বোনের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে ঠিকাদারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।

নারায়ন ঠাকুর হত্যা মামলার পলাতক আসামি ছিলেন। পরে জামাই বাবু রমেশ চন্দ্র সেনের প্রভাব আর রাজনৈতিক দাপটে তারা হয়ে ওঠেন প্রতাপশালী। তার মাসিতো ভাই দুলালকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাসিতো বোনের ছেলে নিপুণকে হাসপাতালের ঠিকাদারি, বোনের মেয়ে মৌ কে স্কুলের শিক্ষিকা, আরেক বোনের ছেলে জয়কে রাজস্ব ও আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি দিয়েছেন তার দুই শতাধিক আত্মীয়-স্বজনকে।

মুক্তা রাণী রায়ের ভাই ফণি রায় বলেন, মুক্তার পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো। পরে নিজে বাড়ি কিনেছে। আমাদের অনেক আত্ময়-স্বজনকে চাকরি নিয়ে দিয়েছেন। এলাকায় কিছু জমিও কিনেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের একজন বলেন, এমপি রমেশ চন্দ্র সেন ও মুক্তা রাণী দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এ বিষয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীসহ সবাই অবগত। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউই কথা বলতে পারতো না। এসব কিছুর তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত এবং সেই সাথে মুক্তা রাণীর অবৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদ ও টাকা সরকারি কোষাগারে নেওয়া হোক।

পৌর শহরের অনেকেই বলেন, এমপির শেল্টারে এলাকায় মুক্তা ও তার ভাই নারায়ন খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। নাম বেনামে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন তারা। তার ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। এমপির দাপটে তার পরিবার ও স্বজনদের চাকরি হয়েছে। হাসপাতাল ও অন্যান্য দপ্তরে চাকরির বিনিময়ে টাকা নিয়েছে আবার কারো কাছে জমিও নিয়েছে। পাশেই মিল-চাতাল পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা অগ্রীমও দিয়েছিল।

এ বিষয়ে মুক্তা রাণীর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ রয়েছে।

ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ২০১০ সালে মুক্তা রাণী আয়া পদে যোগদান করেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি সেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঠাকুরগাঁও সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তাহসীন মুনাবীল হক বলেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নয়। আয় বহির্ভূত সম্পদ উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই। কেউ এসবে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরো পড়ুন : ফারাক্কার ১০৯টি গেট খুলে দিল ভারত, ফের বন্যার আশঙ্কা বাংলাদেশে

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *