সিলেট ব্যুরো: অদিতি রানী (ছদ্মনাম)। ওসমানী মেডিকেলের স্টাফ নার্স। সাসপেন্সনে ছিলেন। এ কারণে বেতন পাননি দীর্ঘদিন। সাসপেন্সন ওঠার পর কাজে যোগদান করেন। কিন্তু তার বেতন-ভাতার বকেয়া প্রায় ৩৬ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে ছিল। এই টাকাগুলো সাম্প্রতিক সময়ে তার নামে ছাড় হয়। টাকা তুলে দিতে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স সিন্ডিকেটের প্রধান ইসরাইল আলী সাদেক ও তার সহযোগীরা তার কাছে ঘুষ হিসেবে দাবি করে ১০ লাখ টাকা। অনেক বলে-কয়ে সেই টাকার পরিমাণ নিয়ে আসা হয় সাড়ে ৬ লাখে। সোমবার সোনালী ব্যাংকের নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেন অদিতি রানী।
আজ সকালে মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে সাদেক চক্রের হাতে টাকা তুলে দেয়ার কথা। ব্যাংক থেকে তোলা ৬ লাখ টাকা নিয়ে সকালে অদিতি যান জরুরি বিভাগে। কিন্তু চতুর সাদেক সেখানে আসেননি। পাঠান আরেক ব্রাদার আমিনুলকে। আগে থেকেই সেখানে ওত পেতে ছিল গোয়েন্দারা। হাতেনাতে টাকাসহ ব্রাদার আমিনুলকে আটক করে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের মতে- আশপাশেই ছিল সাদেক। কিন্তু সে না এসে তার সহযোগী আমিনুলকে পাঠায় সেখানে। অভিযানের পর পরই সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা খুঁজে ফিরছে সাদেককে। তবে দুপুরের দিকে ওই চক্রের আরেক সদস্য ব্রাদার সুমনকে আটক করে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
সাদেক চক্রের কবলে পড়া নার্স অদিতি রানী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সাসপেন্সন ওঠার পর আমি টাকা তুলতে চেষ্টা শুরু করি। তখনই সাদেক ও তার লোকজন সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। এবং ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে তারা ওই টাকা তুলে দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু কাজ তো আমাকে করতে হয়েছিল। তারা আমাকে সাহায্য করে ১০ লাখ টাকা নিতে চেয়েছিল। মঙ্গলবার জরুরি বিভাগের সামনে টাকা নিতে সাদেক আসার কথা ছিল। কিন্তু সে না এসে আমিনুলকে পাঠায়। এরপর আমিনুলকে আটক করা হয়। তিনি জানান, তিনি অসহায়। ওরা ব্ল্যাকমেইল করেছিল। এ ঘটনার পর থেকে তিনি তটস্থ রয়েছেন বলে জানান। কারণ ওসমানীতে ব্রাদার সাদেক সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সবাই। এ কারণে তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলেন না। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঘুষের ৬ লাখ টাকা সহ ওসমানীর ব্রাদার আমিনুলকে আটক করা হয়েছে। এরপর ওই চক্রের সঙ্গে জড়িত সুমন নামের আরও একজনকে আটক করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
তিনি বলেন- ওই চক্রের বিরুদ্ধে আরও নানা অভিযোগ এসেছে। আমরা সবকিছু খতিয়ে দেখছি। এ ছাড়া ঘুষ গ্রহণের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি। আটকের আগে ব্রাদার সুমনও পরিচালকের কক্ষে পুরো ঘটনা স্বীকার করে। এবং তাদের সঙ্গে কারা কারা জড়িত সেটিও বলে। এবং তাদের সিন্ডিকেট প্রধান ব্রাদার ইসরাইল আলী সাদেক বলেও জানায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে সকালে আটক হওয়া ব্রাদার আমিনুলও পুরো ঘটনা স্বীকার করে। এবং সাদেক তাকে টাকা নিতে পাঠিয়েছে বলেও জানায়। ওই সময় সাদেক হাসপাতালেই ছিল বলে জানায় সে।
এদিকে এ ঘটনায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জাফর ইকবাল জানিয়েছেন, মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। ওই নার্স বাদী হয়ে অভিযোগ দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।’ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অঘোষিত রাজা ব্রাদার ইসরাইল আলী সাদেক। সাদেক নার্সেস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। এ কারণে পুরো হাসপাতাল তার কাছে জিম্মি। তার নেতৃত্বে রয়েছে শক্তিশালী অপরাধী চক্র। চাকরি দেয়া, শাস্তি মওকুফ, আউটসোর্সিং বাণিজ্য সহ নানা কাজে ওই সিন্ডিকেট জড়িত। তাদের কাছে খোদ অসহায় ওসমানীর প্রশাসনও। হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ইসরাইল আলী সাদেক নিজেকে আওয়ামী লীগের এক এমপি’র ঘনিষ্ঠজন বলে দাবি করে। তার নেতৃত্বে ভোটের দিন শতাধিক নার্সকে হাসপাতাল থেকে নগরের দুর্গাকুমার পাঠশালাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের ভোট দেয়ার সময় ওই নার্সদের ‘ডামি’ ভোটার হিসেবে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় সিলেটে বিব্রত হন আওয়ামী লীগ নেতারা। ঘটনাস্থলেই তারা সাদেক সহ মন্ত্রীর এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন। নার্সেস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় হাসপাতালের দুর্নীতির সব শাখাতেই তার বিচরণ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অবৈধ ওষুধ সরবরাহ ঘটনার অভিযোগ উঠেছিল। প্রায় তিন বছর আগে র্যাবের অভিযানে অবৈধ প্যাথেড্রিন সহ আটক হয়েছিল সাদেক।
গতকাল হাসপাতালে যখন গোয়েন্দাদের অভিযান চলে তখন হাসপাতালের একজন চিকিৎসক ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পরিচয়দানকারী নাজমুল ইসলাম আসেন পরিচালকের কক্ষে। এ সময় অভিযান বন্ধ না করলে নার্সরা আন্দোলনে যেতে পারে বলে পরিচালককে হুমকি দেন। এ সময় ওই কক্ষে থাকা গোয়েন্দা সদস্যরা তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এবং ধর্মঘটের হুমকি দেয়ায় তার কাছ থেকেও মুচলেকা আদায় করা হয়। অভিযানে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, ব্রাদার্স সাদেকের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি শক্তিশালী দুর্নীতির চক্র রয়েছে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তারা শুধু অবাধ দুর্নীতিই করে না, নার্সদের জিম্মি করে লিভ টুগেদার করে। তাদের কাছে জিম্মি সাধারণ নার্সরা। এমনকি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও তাদের ভয়ে মুখ খুলেন না। প্রমোশন সহ নানাভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়। এর বাইরে ওয়ার্ড, দালাল, ওষুধ সিন্ডিকেট করে টাকা হাতিয়ে নেয়। অভিযানে আটক হয়নি ব্রাদার নার্স। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে খুঁজছে বলে জানান তারা।
আরো পড়ুন : আজ শপথ নিবেন দ্বাদশ সংসদ সদস্যরা, কাল চমক নিয়ে আসছে মন্ত্রিসভা