তিন বছর বয়সী নুহা। মাছ-মাংস ছাড়া কিছুই খেতে চায় না। প্লেটের পাশে ডিম দেখলে বেজায় খুশি। মায়ের দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকে। কিন্তু তিন-চার মাস ধরে বড্ড অভিমান তার। মাছ-মাংসের দেখা নেই। খাবারের প্লেট দেখলেই এদিকে-সেদিকে ছোটাছুটি করে। কখনো লুকিয়ে থাকে টেবিলের নিচে আবার কখনো দেয়ালের পাশে। মা শিরিনা বেগম সন্তানের মুখে খাবার দিলেই কান্নাকাটি করে। শাক-সবজি দিয়ে খেতে চায় না।
নুহা ঠিকমতো খাবার না খাওয়ায় তার অসহায় বাবা-মাও চিন্তিত। নুহার বাবা সিহাব বলেন, তিন-চার মাস ধরে মাছ-মাংস আগের মতো কিনতে পারি না। কয়েকদিন আগেও বাচ্চার পাতে ডিম দিতাম। কিন্তু সেটিরও দাম বাড়ছে। মেয়েটি শাক-সবজি দিয়ে ভাত খেতে চায় না। আগে প্লেটে মাছ-মাংস দেখলে নিজেই দৌড়ে আসতো খেতে। শাক-সবজি খেতে খেতে ও নিজেই এখন বিরক্ত। আয় নেই অথচ দিন দিন সব জিনিসের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে।
নুহার মা শিরিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী একটি হোটেলের কর্মচারী। মাস শেষে ১০ হাজার টাকা বেতন পান। তা থেকে ঘর ভাড়া ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। মেয়েটার জন্য কোনো বাড়তি খাবারও কিনতে পারি না। গত তিন মাস ধরে আমি একটা বাসায় কাজ করি। সেখান থেকে সারাদিন কাজ করে মাসে ৪ হাজার টাকা পাই। এই দু’জনের টাকা দিয়ে কিছুই হয় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম শুধু বাড়তি নয়, একদম নাগালের বাইরে চলে গেছে। সামনের দিনগুলো কীভাবে যাবে তা নিয়ে চিন্তায় আছি।
শুধু নুহার পরিবার নয়, কম আয় করেন এমন পরিবারের মানুষেরা দুঃসহ সময় পার করছেন নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে। নানা প্রয়োজনে যারা শহরে মেসে থাকেন তাদেরও বেড়েছে ভোগান্তি। শুধু কম আয়ের মানুষই না মধ্যবিত্ত ও মধ্যম আয়ের মানুষদেরও নাভিশ্বাস অবস্থা নিত্যপণ্যের উচ্চ দামের কারণে। প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা থেমে নেই। কোনো না কোনো অজুহাতে বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। এ কারণে কম বা সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।
সারাদিন যা আয় করেন তা দিয়ে সংসারের খরচ চালান হেলাল উদ্দিন। তিনি পেশায় একজন রিকশাচালক। কিছুটা বয়সও হয়েছে তার। তিনি বলেন, দিনের আয় দিনে খাই। কখনো ১ হাজার, কখনো ৭০০-১০০০ টাকা আয় হয়। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার সংসার। ঢাকার রাজাবাজারে থাকি। ঘর ভাড়া দিতে হয় ৭ হাজার টাকা। যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে আলু ভর্তা দিয়েই খেতে পারি। বাজার করতে গেলে পকেটে টাকা থাকে না। কী দিয়ে কী কিনবো সব কিছুর দামই তো বাড়তি। এই আয়ের টাকা দিয়ে মাছ-মাংস কেনা যায় না, এগুলো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। শুধু খাওয়া ছাড়া কি সংসারে আর কোনো খরচ নেই? ওষুধপাতিও কিনতে হয়। ছোট সন্তানদের অনেক বাড়তি কিছুর চাহিদা থাকে কিন্তু মিটাতে পারি না। মেজো মেয়েটা কয়েকদিন মাংস খেতে চাচ্ছে কিন্তু দিতে পারছি না। অল্পকিছু মাংস কিনতে গেলেও পকেট থেকে ৫০০-৬০০ টাকা খরচ হয়ে যায়।
কাওরান বাজারের মদিনা হোটেলের ম্যানেজার রাজ বলেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে আমাদের লসে ব্যবসা করতে হচ্ছে। বাজারে গেলে কোনোকিছু কম দামে পাওয়া যায় না। দাম কমার আশায় হোটেল চালিয়ে রাখতে হচ্ছে। আজ যে ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে হয়তো কাল দাম কমলে ভালো যাবে। সামনে নির্বাচন এটিও ভাবাচ্ছে।
এই ব্যবসায়ী মনে করেন নিত্যপণ্যের দামের কারণে মানুষ খাবারের পরিমাণটা আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছে। বাড়তি দামের কারণে মানুষ হোটেলে খাবার কমিয়ে দিয়েছে। আগে যারা হোটেলে আসলে মাছ, মাংস দিয়ে ভাত খেতো তারা এখন কোনোমতে সবজি বা ডাল-ভর্তা খেয়ে চলে যাচ্ছে। ডাল-সবজি, ভর্তা শেষ হয়ে যায় কিন্তু মাছ-মাংস ধরা থাকে। তিনি বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে কর্মচারীও কমিয়ে দিয়েছি।
তেজতুরি বাজারের একটি মেসে থাকেন শিউলি আক্তার। তিনি বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট একটি চাকরিতে যুক্ত রয়েছি। মাসে ৪-৫ হাজার টাকা আয় হয়। গতকাল বাজারে গিয়ে আধা কেজি ঢেঁড়স, আলু আর মরিচ কিনেছি তাতেই অনেক টাকা খরচ। আগে নিয়ম করে একটা ডিম খেতাম কিন্তু সেটি গত দুই মাস ধরে খাচ্ছি না। দুই মাস ধরে কোনো ডিম কিনছি না। মাছ-মাংস তো কিনতেই পারি না। এই টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। সবকিছুর এত দাম বাড়লে আমরা খাবো কী? কীভাবে চলবো। অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে জীবন।
দিনমজুর জসিম বলেন, স্ত্রী- সন্তান ঢাকায় ছিল। দুই মাস হলো তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। নাখালপাড়ার এক রুমের একটি বাসায় তাদের নিয়ে থাকতাম। আমি দিনমজুরের কাজ করি। দিনে ৭০০-৯০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া দেয়ার পরে কিছুই থাকে না। উপায় না পেয়ে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি রংপুরে পাঠিয়ে দিয়েছি। কয়েকমাস আগেও ভালো চলছিল। কিন্তু গত চার মাস ধরে এই টাকায় কিছুই হয় না। বাজারে গেলে কিছুই কিনতে পারি না।
রাস্তায় ফেরি করে আচার বিক্রি করেন মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে কিন্তু মানুষের দাম বাড়েনি। আমরা কার কাছে বলবো এই কষ্টের কথা, কে আছে আমাদের। আমরা নিরুপায়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আরও আগে। এই টাকা দিয়ে কী করবো খাবো না বাসা ভাড়া দিবো। বাসায় গেলে ছোট মেয়েটা দৌড়ে আসে কী নিয়ে এসেছি- তাদের হাতে বাড়তি কোনো খাবার দিতে পারি না। বাজারে গেলে কম দামের মধ্যে কিছুই পাই না। তেল কিনতে গেলে টাকা শেষ। মাছ-মাংস কিনতে পারে না। অথচ এক বছর আগেও এই টাকার মধ্যে অনেক কিছু খেয়েছি।
আরো পড়ুন : ‘বঙ্গবন্ধু প্রিজন্স কাপ-২০২৩’ উদ্বোধন করেন মাশরাফি বিন মুর্তজা