স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। দুই বিভাগে মোট ৭২ জনকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ এবং আগামীকালের মধ্যে বাকি বিভাগ গুলোতে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত হবে। শনিবার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈঠকে রংপুর বিভাগের ৩৩টি এবং রাজশাহী বিভাগের ৩৯টি আসনের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন এমপি দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সভার সূচনা বক্তব্যে সব দলকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, কে কতোদূর দৌড়াতে পারেন এবং জনগণ কাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় তা জানতে আসুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। তিনি বলেন, নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করবেন না। যদি তা করেন, তাহলে এর পরিণতি কারও জন্য ভালো হবে না।
নির্বাচনে অংশ নিতে যেসব দল ঘোষণা দিয়েছে, সেসব দলকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন আমি আপনাদের সবাইকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, আগামী সাধারণ নির্বাচন যে অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা নির্বাচন করবো। এক্ষেত্রে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করবো না। আমরা চাই নির্বাচন কমিশন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করুক। তিনি দেশবাসীকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনি আপনার ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারেন। আমি দেশবাসীকে জাতির সেবায় আরেকবার পরিবর্তন আনতে আমার দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে ভয় পায় কারণ, তাদের দুই শীর্ষ নেতা দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বে কেউ নেই। তিনি আরও বলেন, তারেকের বিরুদ্ধে এফবিআই সাক্ষ্য দিয়েছে এবং কানাডিয়ান পুলিশ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাক্ষ্য দিয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলে প্রতিটি নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় দাবি করে তিনি বলেন, জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে আমরা নির্বাচন করি। আপনাদের ভোটের অধিকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নেবেন। যাকে খুশি তাকে ভোট দিন, এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কথা নেই। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আমার আহ্বান থাকবে, আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিন। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একসময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে থাকা নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করতে আওয়ামী লীগ সরকার আইন করে দিয়েছে, যার অধীনে এখন দেশে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। নির্বাচন আবার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করার জন্য আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করেছে। অবাধ নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু করতে ৮২টি সংশোধনী আনা হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যারা কথা বলে, তাদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের অনেক কথা বলছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে আমার প্রশ্ন, যেভাবে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে, নির্বাচন কলুষিত করেছে, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তখন কোথায় ছিল তারা? তখন তো তাদের কাছ থেকে কোনো কথা শুনিনি! তিনি বলেন, জিয়া ও এরশাদের সময় প্রতিটা নির্বাচন আমরা দেখেছি, ভোট কারচুপির খেলা। ’৯৬-এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কোনো ভোট পড়েনি বলতে গেলে। ভোট চুরি করে খালেদা জিয়া নিজেকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এই ভোট চোরকে মেনে নেয়নি। আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া ৩০শে মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সবার মনে রাখা উচিত, খালেদা জিয়া ৩০শে মার্চ ভোট চুরির কারণে পদত্যাগ করে। শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি যতবার এসেছে, জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ক্ষমতা জনগণের হাতে চলে এসেছে। ২০১৪ সালে বিএনপি’র নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসযজ্ঞ করে তারা নির্বাচনে আসেনি। নির্বাচনে না আসার একটিই কারণ, তাদের আত্মবিশ্বাস নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এসে তারা একটা পর্যায়ে নির্বাচন থেকে সরে যায় এবং নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে অপপ্রচার চালায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ একটা দৃষ্টান্তও দেখাতে পারেনি কোথায় কী অনিয়ম। যদি কিছু দৃষ্টান্ত দেখাতে পারতো, তাহলে কিছু কথা ছিল। আবার দেখলাম তারা সরকার উৎখাত করবে, সে জন্য আন্দোলন করছে। তিনি বলেন, ২৮শে অক্টোবর সন্ত্রাস করে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আক্রমণ করে, মানুষকে মেরে সরকারের পতন ঘটাতে চায় তারা। রাজনীতি যদি মানুষের জন্য হয়, তাহলে সরকারে যাওয়া যায়। কিন্তু তারা যেই কাজগুলো করে যাচ্ছে, তা জনগণ মেনে নেয়নি।
২৮শে অক্টোবরের আগে বিএনপি’র সভা-সমাবেশের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, তারা তো মিটিং মিছিল করে যাচ্ছে। আমরা তো বাধা দেইনি। তাহলে কেন এই অগ্নিসন্ত্রাস? যখন বিএনপি মিটিং মিছিল করছিল, ভদ্রভাবে রাজনীতি করছিল। তাদের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসছিল। এটা বাস্তব কথা যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বেড়েছিল। আস্তে আস্তে মানুষের সমর্থন পাচ্ছিল। জমায়েতও ভালো করছিল। যখন আবার সেই অগ্নিসন্ত্রাস, জালাও-পোড়াও শুরু করেছে, হামলা করেছে, তখন আবার আগের জায়গায় ফিরে গিয়েছে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই তারা আবার জনগণের সামনে চলে এসেছে। সন্ত্রাসী হিসেবে তারা আবার পরিচিতি পেয়েছে।
দেশীয় ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ধ্বংস করার জন্য নানা প্রক্রিয়া করছে বিএনপি। রাজনৈতিকভাবে তারা পারেনি, এখন অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে চাপে ফেলবে, সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পৃথিবীর কিছু মোড়ল আছে, যেখানে তাদের সমর্থন আছে, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও তা মানবাধিকার লঙ্ঘন না। অন্য জায়গায় হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন। এরা দুমুখো। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা ধ্বংস করার এটা একটা চক্রান্ত। বিএনপি-জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসীরা ক্ষমতায় এলে এরা দেশকে আবার খুবলে খাবে, দেশকে পিছিয়ে দেবে। কারণ, এরা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে না, চেতনায় বিশ্বাস করে না, উন্নয়নে বিশ্বাস করে না, শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়ায় বিশ্বাস করে এরা। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। কেউ আগুন দেয়ার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে ধরতে হবে। ধরে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে এবং পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আমরা বলবো না আইন আপনারা হাতে তুলে নিন। তবে এদের ধরতে হবে। পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। কেউ রেহাই পাবে না। বিএনপি’র প্রতি বিদেশিদের সমর্থনের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন দেশ বা কোন বড় দেশ তাদের সমর্থন দিক, তাতে কিছু যায়-আসে না। আমার কাছে আমার বাংলাদেশ বড়। এর থেকে বড় আর কেউ নয়। আমি দেশের জন্য কাজ করি। কারও তাঁবেদারি করার জন্য নয়, পদলেহন করার জন্যও নয়।
৭২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রংপুর বিভাগের ৩৩টি এবং রাজশাহী বিভাগের ৩৯টি আসনের (মোট ৭২টি) দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। আমরা সব আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত তালিকা প্রকাশ করবো না, একসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা ঘোষণা করবো। গতকাল তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। আজ শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা মুলতবি করা হয়েছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, আজকে আমাদের মনোনয়ন বোর্ডের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মধ্যে রাজনীতির বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বর্তমানের সংসদ সদস্য কতোজন বাদ পড়ছেন এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। তবে বাদ পড়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আগামী ২৫শে নভেম্বর প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হবে বলে জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হলে তাদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী, জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, আগে আমরা দেখি কারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়, তারপর সিদ্ধান্ত নেবো।
তিনি বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজমান। জোট হবে বিভিন্নভাবে। কার সঙ্গে কার জোট হবে, কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল। জোট হতেও পারে নির্বাচনের আগে, সময় আছে। কাজেই তালিকাও আসতে পারে। এমনও হতে পারে আপনিও ভাবছেন না, আমিও ভাবছি না। কিন্তু কার সঙ্গে কার জোট হয়, কেউ ভাবতে পারে না। গতকাল সকাল ১০টা ১০ মিনিটে তেজগাঁও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা শুরু হয়। চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোশাররফ হোসেন, কাজী জাফর উল্লাহ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, রাশিদুল আলম, রমেশচন্দ্র সেন, ডা. দীপু মনি। দলীয় সূত্র জানায়, আগের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা দলটির সভাপতির ধানমণ্ডি কার্যালয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে হতো। তবে এবার নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রম করবেন না বলে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের তেজগাঁও কার্যালয়ে হচ্ছে দলটির মনোনয়ন বোর্ডের সভা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। এতে দলটির আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এদিকে হুইল চেয়ারে করে মনোনয়ন বোর্ডের সভায় যোগ দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড সভার সদস্য তোফায়েল আহমেদ।
আরো পড়ুন : ১ দিনে শতাধিক আর ২ মাসে চার শতাধিক বিএনপি’র নেতাকর্মীর সাজা