নিজস্ব প্রতিবেদক: কে হচ্ছেন দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি, তা জানা যেতে পারে আজ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সংসদ ভবনে ক্ষমতাসীন দলের সভাকক্ষে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে রাষ্ট্রপতি পদে দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের একাধিক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সংসদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তারা যাকে মনোনয়ন দেবে, তিনিই হবেন দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি। শেষ মুহূর্তে আলোচনায় এগিয়ে আছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। এ ছাড়া চমক হিসেবে অন্য কাউকে বেছে নেওয়া হতে পারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিকে। তবে অবশ্যই তিনি রাজনীতিবিদ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে তৃণমূলে রাজনীতি করেছেন। দলের জন্য সব সময় নিবেদিত ছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলের মনোনয়ন প্রদানকে অতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ এই রাষ্ট্রপতির অধীনেই নির্বাচন হবে। তাঁকে সব দলের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তেমনি অতীতের ‘অভিজ্ঞতা’ থেকে বিচক্ষণ ব্যক্তিকেই বেছে নিতে চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য রাষ্ট্রপতি পদে একজন রাজনীতিবিদের আসার জোর গুঞ্জন রয়েছে। যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।
২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ না থাকায় তাঁর জায়গায় নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। ২৪ এপ্রিলের মধ্যেই ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নতুন কারও শপথ নেওয়ার কথা। রাষ্ট্রপতির পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিন থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা সংবিধানে বলা হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সে অনুযায়ী স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচন কর্তা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এরপর তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদে ভোট গ্রহণ করা হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি। আগ্রহী প্রার্থীরা ১২ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। রাষ্ট্রপতি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন না। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের ভোটে। রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে হলে সংসদ সদস্য হতে হয় না। তবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে প্রস্তাবক এবং একজনকে সমর্থক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে শপথ না নেওয়া পর্যন্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতি নিজ পদে বহাল থাকবেন।
এ প্রসঙ্গে হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘মঙ্গলবার (আজ) আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে চাচ্ছেন।’ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এখনো রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাকে চান সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথা দলের নেতাদের জানাননি। ফলে এখনো একাধিক নেতার নাম দলের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে শেষ পর্যন্ত দলীয় কোনো নেতাকেই রাষ্ট্রপতি করার সম্ভাবনা বেশি। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই জানা যাবে কে হচ্ছেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আগামী দিনের রাজনীতিতে কোনো সংকট সৃষ্টি হলে যিনি সাহসিকতা, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংকট উত্তরণে সঠিক অবস্থান নিতে পারবেন, এমন একজনকেই রাষ্ট্রপতি করবেন প্রধানমন্ত্রী। দলীয় সূত্র জানান, রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলীয় নেতাদের বাইরে কাউকে মনোনয়ন না দিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বার্তা দিয়েছেন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁদের মতে, ১৯৯৬ সালে সাবেক বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করাটা আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর ছিল না। এবারে যাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হবে তাঁর মেয়াদেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে। ফলে দলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে না এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি পদে চান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে রাষ্ট্রপতি করে বিএনপি যে ভুল করেছিল তা-ও তুলে ধরা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা আছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে নিয়ে। তিনি বর্তমানে তৃতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্য। তাঁর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তাঁর সচিব ছিলেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আস্থাভাজন হিসেবে শিরীন শারমিন চৌধুরীর রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একটি অংশ। শিরীন শারমিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন দেশের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি।
শিরীন শারমিন চৌধুরী পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে সাংবিধানিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে শিরীন শারমিন চৌধুরীর সুনাম ছিল। তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পরে ১৯৮৫ সালে এইচএসসিতে ঢাকা বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। রাষ্ট্রপতি পদে আলোচনায় আছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোশাররফ হোসেন। তিনি চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য। গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। খনিবিদ্যায় প্রকৌশলী এই নেতা ছয়বারের সংসদ সদস্য। ১৯৭০ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচন শুরু করেন। ১৯৭৫-পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আহ্বান তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগের আদর্শে অবিচল থেকেছেন। লোভ-লালসা তাঁকে কখনই স্পর্শ করতে পারেনি। দীর্ঘ জীবনে দেশ, মানুষ আর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন। প্রতারণা, ভণ্ডামি, শঠতা কখনই প্রশ্রয় দেননি। দল তাঁকে মন্ত্রী বানালে দলের হয়ে দেশের জন্য কাজ করেছেন। আবার মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার পরও তিনি কখনো দল ও দলীয় প্রধানের আস্থা হারাননি। তা ছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনের আগের প্রেক্ষাপটে এমন একজনকে দরকার যিনি সব অবস্থায় দলের হয়ে লড়বেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৬৬ সালে ছয় দফায় যোগ দিয়ে মোশাররফ হোসেন পুরোদস্তুর রাজনীতিক বনে যান। ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশ্রস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মোশাররফ এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ এবং ১৯৯৬ থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব ছাড়াও আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাবেক আমলাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে একটি নামই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বারবার আলোচনা হচ্ছে। তিনি হলেন সাবেক সচিব ড. মসিউর রহমান। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা মনে করেন, মসিউর রহমানই এবার রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন। তিনি ২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। সিএসপি কর্মকর্তা মসিউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।