দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছে না বিএনপিসহ সমমমনা দল ও জোট। ‘সরকার পতনের’ একদফা চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে তারা। অভিন্ন কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করলেও আগামী দিনে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামতে চান। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো ৩৯টি রাজনৈতিক দল যৌথসভা করে। একসঙ্গে কর্মসূচি পালনের বিষয়ে একমত হন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। একই সঙ্গে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ সব দলকেও ঐক্যে চান নেতারা। এজন্য ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিএনপির তিন সিনিয়র নেতাকে।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। বিএনপিকে ভাঙতে না পারায় ওই যৌথ সভায় স্বস্তি প্রকাশ করেন নেতারা। এটাকে বিএনপির প্রাথমিক বিজয় বলে উল্লেখ করেন তারা। আজ শুক্রবার থেকে আত্মগোপনে থাকা নেতারা মাঠে নামার পাশাপাশি নানা সংগঠনের ব্যানারেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে বলে যৌথসভায় উপস্থিত বিএনপির এক নেতা জানান। এরই অংশ হিসাবে আজ সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শ্রমিক সমাবেশ হবে। সভা সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিকালে তোপখানা রোডের শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে ৩৯ দলের ওই যৌথসভা হয়। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম যুগান্তরকে বলেন, ‘সভায় চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মকৌশলসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। আগামী দিনে একই কর্মসূচি ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের বিষয়ে নেতাদের ফোকাস ছিল। এ বিষয়ে একমত নেতারা। তবে কবে থেকে তা হবে তা নিয়ে আরও কয়েকটি সভা হতে পারে। একই সঙ্গে নির্বাচন বর্জন করা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’ জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘সামনে একই মঞ্চে ও একই সঙ্গে আন্দোলন হবে। আশা করি সেখানে নির্বাচন বর্জন করা সব দল থাকবে।’
সভায় অংশ নেওয়া আরও একাধিক নেতা জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে কিংস পার্টিগুলোর নানা তৎপরতা দৃশ্যমান ছিল। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নির্বাচনে নিতে নানা ভয়ভীতি ও প্রলোভনও দেখানো হয়েছে। আশঙ্কা ছিল বিএনপি ভাঙার। কিন্তু বাস্তবে তা সফল হয়নি। কিংস পার্টিতে পরিচিত কোনো নেতাকে দেখা যায়নি মনোনয়নপত্র তুলতে। বিএনপির দু-একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়তো প্রলোভনে পা দিয়েছেন, কিন্তু জাতির সামনে তাদের সম্মান একেবারে নিচে নেমেছে। নেতারা আরও জানান, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল ছাড়া নির্বাচন বর্জন করা সব দলই থাকতে পারে। তবে বাম দলগুলোও প্রায় একই দাবিতে পৃথকভাবে মাঠে থাকবে।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের সভাপতিত্বে যৌথসভায় বিএনপি, লেবার পার্টির দুই অংশ, এনপিপি, গণদল, জাগপার দুই অংশ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, এলডিপি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী), বাংলাদেশ জাতীয় দল, ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ), বাংলাদেশ এলডিপি, এবি পার্টি, সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া), সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, গণফোরাম (মন্টু), এডিপি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (নুরুল হক নুর), জাস্টিস পার্টি, বিকল্পধারা (একাংশ), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, ডিএলসহ ৩৯ দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সভার পর নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে আসছি। দাবিগুলো ইতোমধ্যে গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। তবে সরকার পদত্যাগের গণদাবিকে উপেক্ষা করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি একতরফা নীলনকশার নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে। সরকারের এই রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সরকারের সহযোগী হিসাবে নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছে। জনগণের ভোটের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সবাই এই নির্বাচনের তফশিলকে প্রত্যাখ্যান করছি।’
ঘোষিত নির্বাচনি তফশিল বাতিলের দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিলম্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আরও বলা হয়, ‘সরকার যদি জেদ, অহমিকা নিয়ে জবরদস্তি করে নির্বাচনের নামে আরেকটি তামাশা মঞ্চস্থ করতে চায়, তাহলে এই অশুভ তৎপরতা প্রতিরোধ করা ছাড়া দেশবাসীর সামনে অন্য কোনো পথ থাকবে না।’
পৃথক বিবৃতিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম দেশবাসীকে একতরফা পাতানো নির্বাচন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় বলা যায় আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশা করা চরম বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকারকে নির্বাচনে কোনোভাবে সহযোগিতা না করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান চরমোনাই পির। একই সঙ্গে তিনি দলীয় কোনো নেতাকর্মীদের নির্বাচন ও ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বানও জানান। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একতরফা গণবিরোধী তফশিল ঘোষণা করে দেশকে রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
দেশের জনগণ, আন্তর্জাতিক মহল এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগ প্রহসনের নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হিসাবে দেখানোর জন্য ডামি প্রার্থী দিয়ে একটি নতুন নাটকের আয়োজন করতে যাচ্ছে। নিজেদের দলীয় লোকদের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়ে এবং কতিপয় বিশ্বাসঘাতক ও স্বার্থপর লোক দ্বারা পাতানো নির্বাচনের চক্রান্ত করছে। রাজনৈতিক দল হিসাবে এটা আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে।’
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের পর থেকে হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট। যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও একই কর্মসূচি পালন করছে জামায়াতে ইসলামীও। হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। সমর্থন জানিয়ে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করছে এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
আরো পড়ুন : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৫ আসনে লড়বেন ১১ প্রার্থী