খালেদা জিয়াকে চিচিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর দাবি অনেকদিনের। এজন্য পরিবারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে বারবার বলা হচ্ছে দেশেই খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে।
আইনমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্তের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আর এটা প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায়। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর কথা বলছেন। একবার, দু’বার নয়, বারবার তারা বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বিদেশ পাঠানোর কথা বলেছেন। শেষমেশ বিএনপি’র পক্ষ থেকে আল্টিমেটামও দেয়া হয়েছে। তারপরও আইনমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে হলে তাকে ফের কারাগারে যেতে হবে। তারপর আবারও আবেদন করতে হবে।
খালেদা জিয়া দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী। তার গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে এমন ঠেলাঠেলি আসলে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? এ নিবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি কথা। তাহলো- খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠাতে সরকার ইতিবাচক। তবে কখন, কোন দেশে পাঠানো হবে তা নিশ্চিত করে কোনো সূত্রই বলতে পারেনি। এই খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানো নিয়ে বেশ ক’দিন ধরেই জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে আইনমন্ত্রী সপ্তাহ দশদিন আগে তার নির্বাচনী এলাকা আখাউড়ায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয় তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। তার এ বক্তব্য দেশের সবক’টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি এ বক্তব্যের পরই জোর আলোচনা শুরু হয় তাহলে খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আইনমন্ত্রী আবার সেই নির্বাহী আদেশের পুরনো কথা বলতে থাকেন। একই সঙ্গে দু’টি শর্তের কথাও সামনে আনেন। ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন- খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর কোনো আবেদন আমার কাছে করা হয়নি। অথচ পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করে চলতি মাসের চার তারিখে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোটভাই শামীম এস্কান্দর আবেদনটি করেছেন।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে- আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এমন বক্তব্যের জবাবে সংবাদ মাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার। আবদুস সাত্তার জানান, নতুন করে তো আবেদন করার প্রয়োজন নেই। চলতি মাসের ৪ তারিখ ম্যাডামকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয়ার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে মিডিয়াতে না বলে আমাদেরকে জানাতে পারতো। কিংবা পরিবারের সদস্যদের ফোন করে জানাতে পারতো। আমাদের সবার মোবাইল নম্বর তাদের কাছে আছে। সরকার যদি অনুমতি দেয়- তাহলে একটি নয় একশ’টি আবেদন দিতেও আমাদের আপত্তি নেই। তিনি আরও বলেন, আমরা অতীতেও দেখেছি- আইনে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী। ওদিকে বিএনপি বলে আসছে খালেদা জিয়ার অবস্থা সংকাটাপন্ন। তাকে বিদেশ পাঠানো জরুরি। বিদেশ ছাড়া তার চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়।
দেশে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এজন্যই তারা সরকারের প্রতি আল্টিমেটাম দেন। এ আল্টিমেটাম দেয়ার পরই আলোচনা তীব্র হয়। নড়েচড়ে বসে সরকার। আগের রাতে খবর চাউর হয় খালেদা জিয়াকে রাতেই বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সরব হয়ে ওঠে। কিন্তু দেখা যায় সবই গুজব। প্রশ্ন হলো- এ গুজব কি সত্যি হবে? খালেদা জিয়াকে সুস্থ করতে হলে বিদেশ পাঠানো জরুরি। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে দীর্ঘ দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কথা বলতে গিয়ে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এসে জনসভায় কাঁদলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বক্তৃতা দিতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, হাসপাতালে ম্যাডামকে দেখতে গিয়েছিলাম। ম্যাডামের এমন চেহারা আর কখনো দেখিনি। এ কথা বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, যে নেত্রী সবসময় অত্যন্ত শক্ত মনের জোর নিয়ে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠেন, তিনি পাঁচ বছর বন্দি থাকা অবস্থায় কোনোদিনও তার চোখে আমি পানি দেখিনি।
গতকাল তাকে আমি অত্যন্ত অসুস্থ দেখেছি। আমার প্রথমবারের মতো মনে হয়েছে- আমাদের নেত্রী অনেক বেশি অসুস্থ। মির্জা ফখরুল বলেন, এই নেত্রী বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য এখনো গৃহবন্দি হয়ে আছেন। গৃহবন্দি অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে তিনবার হাসপাতালে এসেছেন। এবার তাকে নিয়ে ডাক্তাররা চিন্তিত। পাশের রুমে আমি যখন ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে গেছি তখন ডাক্তাররা বলেছেন, আপনাদের যদি কিছু করার থাকে তাহলে করেন। দেশনেত্রীর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। স্পষ্ট করে সরকারকে বলতে চাই- আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশনেত্রী বেগম খালেদ জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। অথবা নেত্রীর যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে শুধু পরিবারের নয়, বিএনপি’র নয়- বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। ডাক্তার, বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য অনুযায়ী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। দেড় মাস ধরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। উল্টো দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ৭৮ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়ায় গত এক সপ্তাহে দু’বার হাসপাতালের কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করতে হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডের এক সদস্য সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেড় মাস চিকিৎসার পরও অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। লিভার সিরোসিসের কারণে তার পেটে পানি চলে আসছে প্রতিনিয়ত। সেটা অপসারণ করতে হচ্ছে। প্রায়ই শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। মেডিকেল বোর্ড সার্বক্ষণিক তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি’র স্বাস্থ্য-বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে ম্যাডামের শারীরিক যে অবস্থা তাকে বিদেশে নিয়ে এডভান্স মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সেন্টারে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন। বাংলাদেশের হাসপাতালে এই চিকিৎসাটা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি- দ্রুত তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেয়া হোক।
বিএনপি’র পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সভায় বলেছেন, আজকে যখন খালেদা জিয়ার জীবন-মরণ সমস্যা তখন তাকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন বন্দি নন, এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক নম্বর নেত্রী। একবার নয়, তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, দুইবার বিরোধী দলীয় নেত্রী। এখনো কারাগারে থেকেও এই অসুস্থ অবস্থায় লড়াই করে যাচ্ছেন।
এই নেত্রীকে সরকার বন্দি রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারাবন্দিদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর নজির আছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সব বন্দিকে চিকিৎসা দিতে হবে এবং চিকিৎসার জন্য যদি প্রয়োজন হয় তাকে বিদেশেও পাঠাতে হবে। বারবার তার পরিবার থেকে, তার ডাক্তাররা এবং আমাদের দলের পক্ষ থেকে বলেছি যে, মানবিক কারণে তাকে চিকিৎসার স্বার্থে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানো হোক।
শেষ খবর হলো- সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দিতে পারে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এজন্য খালেদা জিয়াকে নিয়ে তার পরিবার ও দল প্রস্তুতও রয়েছে। যদি এমনটাই হয়, তাহলে দেরি কেন? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি করা হোক। মির্জা ফখরুলের ভাষায়- খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে- কেন এর দায় সরকার নিতে যাবে?
খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে রাজনীতির মারপ্যাঁচে না ফেলে সত্যিকার অর্থে একটি উদ্যোগ নেয়া হউক। যাতে তিনি সঠিক চিকিৎসা পেতে পারেন। সরকারও তার উদার মনোভাবের পরিচয় দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে পারেন। যে কথা বর্তমানে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে সে কথার সত্যতা দেশবাসী দেখতে চায়।
আরো পড়ুন : তাহলে কি অনিশ্চিত এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ?