গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে গত বছরের অক্টোবর মাসের ভিজিডি কর্মসূচির ১৯৩ জনের প্রায় ১৪৫ মণ চাল আত্মসাত করেন। পরে এ নিয়ে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি ভুক্তভোগী কয়েকজন নারী গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দিলে ২৪ জানুয়ারি চাল পান কার্ডধারীরা। কিন্তু যে চাল দেওয়া হয়েছে তা পঁচা, লাল, পোকা ধরা। যা খাবার অযোগ্য বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে দুঃস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। ইউপি চেয়ারম্যান বা তার প্রতিনিধি সরকারি গোডাউন থেকে চাল উত্তোলনের সময় আদ্রতা, ধুলাবালি, পোকামাকড়, মরা/নষ্ট/ভাঙা শস্য এবং অন্য কোন ক্ষতিকারক উপাদান আছে কিনা তা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নেবেন। এর ব্যতয় ঘটলে তিনি জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অবহিত করবেন। পরে উত্তোলন করা এই চাল একজন ট্যাগ অফিসারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তা ভিজিডি কার্ডধারীদের দেওয়া হয়।
ওই লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে মহিমাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ হতে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে ভিজিডি কার্ডে চাল বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু গত অক্টোবর মাসে বরাদ্দকৃত ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমরা সুবিধাভোগীরা মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে কার্ড নিয়ে গেলে তিনি নানা অজুহাত দেখান ও দিবো দিবো বলে সুবিধাভোগী ১৯৩ জনকে হয়রানী ও অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন। পরে আমরা সুবিধাভোগীরা খোঁজ করে জানতে পারি যে, গত অক্টোবর মাসের চাল আত্মসাত করা হয়েছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দুর্নীতিকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানানো হয় ওই অভিযোগে। মহিমাগঞ্জের বোচাদহ গ্রামের গোলাপী বেগম, পুনতাইড় গ্রামের রেহেনা বেগম ও গোপালপুর গ্রামের লাইলী বেগম এই অভিযোগ দেন। অভিযোগের এই কপি দেওয়া হয় গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক এবং জেলা ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরেও।
এসব কার্ডধারী সুবিধাভোগীর কয়েকজনের কার্ডে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সবগুলো ঘর লেখা থাকলেও অক্টোবর মাসের ঘর ফাঁকা। সেই ঘরে কিছুই লেখা নেই। তবে সেই কার্ডে দেখা গেছে কিছু অসঙ্গতিও। যেমন জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের চাল দেওয়া হয়েছে ১৮ এপ্রিল। এপ্রিলের চাল ২৩ মে, মে ও জুনের চাল ১৩ জুলাই, জুলাইয়ের চাল ৮ সেপ্টেম্বর, আগষ্টের চাল ১৭ অক্টোবর, সেপ্টেম্বরের চাল ৪ নভেম্বর, অক্টোবরের চাল দেওয়া হয়নি, নভেম্বরের চাল ১ ডিসেম্বর ও ডিসেম্বরের চাল চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি।
অভিযোগকারী গোলাপী বেগম, রেহেনা বেগম ও লাইলী বেগম জানান, গত ৩১ অক্টোবর সরকারি গোডাউন থেকে ১৯৩ জন কার্ডধারীর ১৪৪.৭৫ মণ চাল উত্তোলন করেন ইউপি সচিব আবদুল জব্বার প্রধান। যার বাজারমূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা। ইউপি চেয়ারম্যান, সচিব ও সংশ্লিষ্ট ট্যাগ অফিসারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে এই চাল আত্মসাতের চেষ্টা করেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেকবার চেয়ারম্যান ও সচিবের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা আমাদের কথায় কোন সাড়া দেননি। উল্টো আমাদের ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন। পরে অভিযাগে দেওয়ার পর গত সোমবার চাল দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই চাল পঁচা, লাল, পোকা ধরা, খাবার অযোগ্য। রান্না করলে গন্ধ করে। এটা গোডাউনের চাল নয়। গোডাউন থেকে উত্তোলন করা ভাল চাল বেশি দামে বিক্রি করে বাজার থেকে কম দামে খারাপ চাল কিনে আমাদের দেওয়া হয়েছে। এখন সেই চাল হাঁস-মুরগিকে খাওয়াচ্ছি। গরু-ছাগলকে খাওয়াবেন বলে কম দামে এই চাল অনেকে কিনে নিয়েছেন। তবে কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে এই চাল দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান সুবিধাভোগীরা। যে যখন জানতে পারছেন সে তখন নিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে মহিমাগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মো. রুবেল আমিন শিমুল জানান, ওগুলো চাল দেওয়া কমপ্লিট। বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্য একটি পক্ষ চাল নষ্ট বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। গোডাউন থেকে যে চাল উত্তোলন করা হয়েছে সেই চালই দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। চাল উত্তোলনের বিষয়টি অস্বীকার করে মহিমাগঞ্জ ইউপি সচিব আবদুল জব্বার প্রধান বলেন, অক্টোবরের ডিও ছিল চেয়ারম্যানের নামে। চাল উত্তোলন করেছেন চেয়ারম্যান। চাল বিতরণ বাকী ছিল, তা চেয়ারম্যান দিয়ে দিয়েছেন। কোথায় থেকে দিয়েছেন তা আমি বলতে পারবো না। তিনি আরও বলেন, চাল নষ্ট নয়, নষ্ট হলে কি চাল মানুষ নেয়। গত ১৩ জানুয়ারি এই চাল দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন সচিব। তবে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক স্বপন কুমার দে বলেন, গত ৩১ অক্টোবর ইউপি সচিব এই চাল উত্তোলন করেন। তাকে ভাল চালই দেওয়া হয়েছে। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছা. জেবুন নেছাকে গতকাল বিকেলে কয়েকবার কল করলে তাকে কল ওয়েটিংয়ে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে কোন অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টি নিয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সাথে কথা বলবো।
ফারুক হোসেন, গাইবান্ধা।