বিবিসি বাংলা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পালিয়ে বেঁচেছিল নোয়ার পরিবার। জার্মানির নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধন থেকে বাঁচতে দুর্বিষহ এক সময় পার করতে হয়েছিল তাঁদের। বহু বছর পর আবারও জার্মানিতে বিপত্তির মুখে পড়েছেন অনেক ইহুদি। একই অবস্থা নোয়ারও। নিরাপত্তার জন্য তাঁরা নিজেদের পরিচয় গোপন করছেন।
বার্লিনের একটি সিনাগগে (ইহুদি উপাসনালয়) বসে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন নোয়া। বললেন, ‘এটা ভীতিকর। আমার পরিচয়ের জন্য কেন আমাকে ভয়ে থাকতে হবে?’ ইহুদি এই নারীর মতো অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন অ্যারন নামের আরেক ব্যক্তিও। লোকজনের মধ্যে ইহুদি ধর্মের ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলো পরতে এখন মোটেও স্বস্তি পান না তিনি।
নোয়া ও অ্যারনের সমস্যাটা জার্মানিতে দিন দিন বাড়তে থাকা ইহুদিবিদ্বেষ ঘিরে। গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত শুরু হওয়ার পর এই বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। শুধু জার্মানিই নয়, ইহুদিবিদ্বেষ ছড়িয়েছে ইউরোপজুড়েই। এমনকি এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিদের বেশির ভাগই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
জার্মানির ইহুদিবিদ্বেষী অতীতের কারণে দেশটিতে ইহুদিরা এখনো নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না—এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে বরাবরই ইসরায়েলের পাশে থেকেছে বার্লিন। একে তারা ঐতিহাসিক দায়িত্ব হিসেবে মনে করে। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যারকেলের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তিগুলোর একটি ছিল ইসরায়েলের নিরাপত্তা।
বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজও একই পথে হেঁটেছেন। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সম্প্রতি তেল আবিব সফরে গিয়ে শলৎজ বলেছেন, ‘এই কঠিন সময়ে আমাদের একটি অবস্থানই হতে পারে। তা হলো ইসরায়েলের পক্ষ নেওয়া।’ জাতিসংঘে বিভিন্ন প্রস্তাবেও ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দিয়েছে বার্লিন।
তবে গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় প্রাণহানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জার্মান সরকারের এই ইসরায়েল নীতির প্রতিবাদে বার্লিনসহ দেশটির বিভিন্ন শহরের রাস্তায় বিক্ষোভে নেমেছে লোকজন। তবে ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানোর ভয়ে ইসরায়েলবিরোধী অনেক সমাবেশ করতে দিচ্ছে না জার্মান সরকার। যেসব সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে থাকছে কড়া পুলিশি পাহারা।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের সমর্থনে এমনই এক সমাবেশে অংশ নেন প্রায় ৯ হাজার মানুষ। তাঁদের একজন নাদিম জারার। ইসরায়েলের বিষয়ে জার্মানির পক্ষপাতের সমালোচনা করে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত এই ব্যক্তি বলেন, গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে বার্লিনকে অবশ্যই মুখ খুলতে হবে। সমাবেশে ইসরায়েলের কড়া সমালোচনা করে সামি নামের আরেক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কী করা হচ্ছে…আমরা সবাই ভিডিওতে দেখেছি, ইসরায়েল শিশুদের সঙ্গে কী করছে।’
এসব সমাবেশ নিয়ে জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর রবার্ট হাবেক বলেছেন, ইসরায়েলের সমালোচনা করার সুযোগ অবশ্যই আছে। তবে একটি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের টিকে থাকার অধিকারকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে না। কারণ, ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষায় জার্মানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এদিকে বার্লিনে ফিলিস্তিনপন্থী অনেক সমাবেশ থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলে হামাসের হামলা উদ্যাপন করতে দেখা গেছে বার্লিনের রাস্তায়। অনেকে স্লোগান দিয়েছেন, ‘নদী থেকে সাগর তীর, স্বাধীন হবে ফিলিস্তিন’। এ ছাড়া গত মাসে বার্লিনের একটি সিনাগগে দুটি পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। এসব নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন দেশটিতে বসবাসকারী ইহুদিরা।
জার্মান সরকারের ইহুদিবিষয়ক কমিশনার ফেলিক্স ক্লেইন বলেন, ‘যখন বিষয়টি ইহুদিবিদ্বেষী ও ইসরায়েলবিরোধী দিকে মোড় নেয়; লোকজন “নদী থেকে সাগর তীর, স্বাধীন হবে ফিলিস্তিন”—এমন স্লোগান দেয়, তখন তা সমস্যার। এমন স্লোগানের মাধ্যমে ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রেও নিরাপত্তাহীনতায় ইহুদিরা
জিউস ফেডারেশন অব নর্থ আমেরিকা (জেএফএনএ) বৃহস্পতিবার একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, হামাস–ইসরায়েল সংঘাতের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদিরা। দেশটির দুই–তৃতীয়াংশ ইহুদি বলেছেন, তাঁদের সম্প্রদায়ের লোজকনের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও ভয় দেখা দিয়েছে।
ইসরায়েল-হামাস সংঘাত শুরুর পর মার্কিন ইহুদিদের ওপর এর প্রভাব নিয়ে এই প্রথম জরিপ চালানো হলো। জরিপে দেখা গেছে, সংঘাত শুরুর পর নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকজন শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন ২৯ শতাংশ মার্কিন ইহুদি।
গত ২৯ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত জরিপটি করেছে বেনেনসন স্ট্র্যাটেজি গ্রুপ। এতে অংশ নিয়েছেন ৩ হাজার ৭৭৭ জন। তাঁদের মধ্যে ২ হাজার ১৯৯ জন ইহুদি। এই ইহুদিরা জানিয়েছেন, পাঁচ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবিদ্বেষ বেড়েছে। জরিপ বলছে, যেসব ইহুদি ধর্মীয় পোশাক পরেন, তাঁরা অন্যদের তুলনায় নিজেদের দ্বিগুণ নিরাপত্তাহীন বলে মনে করেন।
জেএফএনএর প্রধান নির্বাহী এরিক ফিনগারহাট বলেন, ‘এই জরিপ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে আমাদের সম্প্রদায় কেন ওয়াশিংটনের দ্বারস্থ হওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। তারা এটা মনে করছে, যেন আমরা জাতীয় নেতাদের কাছে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এবং ইসরায়েলের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে পারি।’
আরো পড়ুন : ঝালকাঠিতে গাছের ডাল কাটাকে কেন্দ্র করে ফুফুর উপর ভাতিজার হামলা, আদালতে মামলা